মঙ্গলবার, ১ মার্চ, ২০১৬

সহীহ হাদীস বনাম আহলে হাদীস



সহীহ হাদীস বনাম আহলে হাদীস
মুফ্তি মুহাম্মদ মাহমুদুল হাসান

কোন সাবজেক্ট বা বিষয়ে দক্ষ বিজ্ঞজনের অনুসরণ-অনুকরণ করা সৃষ্টিগত স্বাভাবিক ব্যাপার এবং সর্বজন স্বীকৃত একটা অনিবার্য বিষয় আল্লাহ তায়ালা মানব জাতিকে অনুসরণের গুণ বা বৈশিষ্ট্য দিয়ে সৃষ্টি করেছেন বিধায় ব্যক্তিগত, আর্থসামাজিক, ভৌগোলিক সর্বক্ষেত্রে তাকে দেখা যায় অনুকরণকারী হিসেবে যার ফলে ক্ষেত-খামার শিল্প-বাণিজ্য, শিক্ষা-দীক্ষা সবই অভিজ্ঞদের অনুকরণে নিয়ন্ত্রিত চেতনে-অবচেতনে আমরা সবাই পরস্পর থেকে কিছু না কিছু শিখতে থাকি এমনকি আমাদের সকল প্রকার উন্নতি-উৎকর্ষ এই অনুসরণের সুফল আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, স্বাস্থ্য-চিকিৎসা থেকে শুরু করে প্রতিটি বিষয় একজন অদক্ষ-অনভিজ্ঞ ব্যক্তি সঠিক সুনিপুণ এবং নিরাপদ পদ্ধতিতে জানতে হলে অবশ্যই তাকে কোন একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তির অনুসরণ-অনুকরণ করতে হবে অনুরূপভাবে ধর্মীয় ব্যাপারে কুরআন-সুন্নাহর উপর গবেষণা করে সমসাময়িক ভবিতব্য বিষয়ের সমাধানের ক্ষেত্রে অক্ষম অনভিজ্ঞ ব্যক্তির জন্য পরিপক্ষ পর্যাপ্ত জ্ঞান সম্পন্ন অভিজ্ঞ ব্যক্তির তাকলিদ বা অনুসরণ একান্ত প্রয়োজন উল্লেখ্য যে, পরিপূর্ণ অভিজ্ঞতা সম্পন্ন, কুরআন-সুন্নাহর ইলমে পারদর্শী, পন্ডিত-মুজতাহিদ ওলামায়ে কেরামের মাধ্যমে কুরআন-সুন্নাহ ভিত্তিক প্রদর্শিত মত পথ এবং প্রতিষ্ঠিত নীতিমালার নামইমাযহাব
মাযহাব মানার রীতি নতুন কোন বিষয় নয় বরং সাহাবায়ে কেরামের যুগেও প্রথা বিদ্যমান ছিল বর্তমান চার মাযহাবের পূর্বেও মাযহাব ছিল তবে ছিল না এসব নামে সাহাবা-তাবিয়ীদের মাঝে যাঁরা মুজতাহিদ বা বিজ্ঞ ছিলেন, তাঁদের প্রত্যেকের মত বা মাযহাব ছিল অন্যরা তাঁদের মাযহাবের অনুসরণ বা তাকলিদ করতেন এবং তাঁদের থেকেই শরয়ী বিষয়ে সমাধান নিতেন তবে সে সব সাহাবী তাবিয়ীদের মধ্য থেকে ব্যক্তি বিশেষ কারো মাযহাব সুবিন্যস্তভাবে সংকলন হয়ে গ্রন্থাকারে সংরক্ষিত হয়নি বিধায়; তাঁদের বিক্ষিপ্ত মাযহাবকে মুসলিম উম্মাহর কল্যাণে চার ইমাম কুরআন-সুন্নাহর নীতিমালা অনুসরণে সুবিন্যস্ত করেন তাঁদের স্ব স্ব গবেষণা, কিয়াস ইজতিহাদের মাধ্যমে উদ্ভাবিত পন্থা তাঁদের নামানুসারেমাযহাবহিসেবে পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠা পায় কাজেই চার মাযহাবের পূর্ববর্তী মুসলমানগণ যেমনি ভাবে মাযহাবের অনুসরণে কুরআন-সুন্নাহর উপর আমল করেছেন, তেমনি করে চার মাযহাব প্রতিষ্ঠা লাভ করার পর থেকে পৃথিবীর সকল মুসলিম মিল্লাত এই ফিক্বহী সমাধান বা মাযহাবের অনুসরণ করে আসছেন
প্রায় তের-চৌদ্দশত বছর যাবত কালের এই বুনিয়াদি আমলকে অস্বীকার করতঃ তথাকথিত আহলে হাদিস সম্প্রদায় মুসলিম সমাজে বিভাজন সৃষ্টি গোমরাহীর নিমিত্তে বলে বেড়ায়- ‘মাযহাব মানা বা ইমামের অনুসরণ প্রয়োজন নেই, সরাসরি হাদীসের উপরই আমলই যথেষ্ট তাদের এই দাবী ভিত্তিহীন কুরআন-হাদীসের সম্পূর্ণ পরিপন্থি বাস্তব সত্য হলো- তাদের সাথে হাদীসের কোন সম্পর্ক নেই তাই তারা শুধু মাযহাব অস্বীকারকারী নয় বরং হাদীস অমান্যকারী এজন্য শরয়ী মাসয়ালার ক্ষেত্রে ইমাম বুখারীর ওস্তাদ ইমাম আবু বকর ইবনে আবী শায়বা (.) এর প্রসিদ্ধ বৃহৎ হাদীসের গ্রন্থমুসান্নাফি ইবনে আবী শায়বা’, ইমাম বুখারীর দাদা ওস্তাদ ইমাম আবু বকর আব্দুর রাজ্জাক এর জগৎ খ্যাত হাদীসের কিতাবমুসান্নাফি আব্দির রাজ্জাক’, সহীহ ইবনে খুজাইমা, সহীহ ইবনে হিব্বান, তাবরানী, শরহে মায়ানিল আসার, আল-মুসতাদারাক আলাস-সহীহাইন, মুসনাদে ইমাম আযম, মুয়াত্তায়ে ইমাম মালিক, মুয়াত্তায়ে ইমাম মুহাম্মদ, মুসনাদে আবী ইয়ালা, তারীখুল কবীর, আল-আদাবুল মুফরাদ, মুসনাদে বাজ্জাজ আস-সুনানুস সুগরা, শুয়াবুল ঈমান, কানযুল উম্মাল, মাসনাদুল ফিরদাউস, সুনানু দারিমী, জামউল জাওয়ামি, মাজমাউজ জাওয়ায়ীদ, হাদীসের অন্যতম বিশাল গ্রন্থ মুসনাদে আহমদ সহ অসংখ্য হাদীসের কিতাব থেকে দলীল হিসাবে হাদীস পেশ করা হলে, তারা বলে- হাদীস সিহাহ সিত্তাতে নেই, তাই মানা যাবে না
তাদের দাবী অনুসারে যদি ইবনু মাযাহ. তিরমিযি, নাসায়ী, আবু দাউদ এসকল সিহাহ সিত্তার কিতাব থেকে হাদীসের বরাত দেওয়া হয়; তখন তারা বলে, এই হাদীস সহীহ বুখারী-মুসলিমে নেই, তাই মানা অসম্ভব যদি সহীহ মুসলিম থেকে বলা হয়, তখন মুখ বাঁকা করে বলেÑ এটা বুখারীতে নেই পরিশেষে সহীহ বুখারী থেকে কোন হাদীসের রেফারেন্স দেওয়া হয়; তাদের স্বার্থ পরিপন্থী হলে বিনাদ্বিধায় বলে, অত্র হাদীস সহী হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ আছে কথায় কথায় হাদীসের জিকির করে নিজেদেরকে হাদীসের একমাত্র ধারক-বাহক প্রেমিক দাবী করলেও প্রকৃত অর্থে- তারা হাদীস অমান্যকারী একটি দল; যা উক্ত বর্ণনা দ্বারা সহজে অনুমান অনুধাবন করা যায়
সাম্প্রতিক কালে মাযহাবের বিরুদ্ধে যারা যত মন্দ অশালীন বক্তব্য দিতে সক্ষম তারাই নিজেদেরকে শীর্ষ পর্যায়ের আহলে হাদীস মনে করে হৃদয়ে প্রশান্তি লাভ করে অথচ হাদীস জানা-বুঝার যে সকল নীতিমালা রয়েছে এগুলো একটিরও ধার ধারে না বরং মনে করে দলীয় ফরম পূরণ করলেই হাদীসের পন্ডিত বনে যায় লা-মাযহাবী আহলে হাদীসের এই অজ্ঞতা দুরাবস্থার কথা চিন্তা করেই তাদের দলীয় শীর্ষ নেতা জনাব সিদ্দিক হাসান খান ভূপালী দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, تراهم يقصرون النقل ولايصرفون العناية إلى فهم السنة ويظنون أن ذالك يكفيهم وهيهات بل المقصود من الحديث فهمه وتدبّر معانيه دون الإقتصار على مبانيه- - অর্থাৎ: আপনি তাদেরকে (আহলে-হাদীস) শুধু হাদীস বর্ণনা করতে দেখবেন, অথচ হাদীস বুঝার ক্ষেত্রে তাদের ভ্রুক্ষেপই নেই এটাকেই তারা যথেষ্ট মনে করে আফসোস! (কারণ, এটা ভ্রান্ত ধারণা মূল উদ্দেশ্যে থেকে বহু দূর) বরং নিছক শব্দের গন্ডিতে সীমাবদ্ধ না রেখে হাদীসকে গভীরভাবে বুঝে এর অর্থ মর্ম নিয়ে গবেষণা করাই মূল উদ্দেশ্য
তাদের উক্ত ইমাম নবাব সিদ্দিক হাসান খান আহলে হাদীসের হাক্বিকত তুলে ধরে ব্যক্ত করেন,
ولا يعرفون من فقه السنة فى المعاملات شيئا قليلا- ولايقتدرون على إستخراج مسئلة وإستنباط حكم على أسلوب السنن وأهلها، وهم إكتفوا على العمل بالدعاوى اللسانية وعن إتباع السنة بالتسويلات الشيطانية-
অর্থাৎ: তারা (আহলে হাদীস সম্প্রদায়) লেনদেন বিষয়ক হাদীসের গুঢ়তত্ত্বে সামান্যতম জ্ঞানও রাখে না সুন্নাত আহলে সুন্নাতের নীতিমালার আলোকে হাদীস থেকে একটি মাসয়ালাও উদঘাটন করতে সক্ষম নয় তারা আমল সুন্নাতের অনুসরণের পরিবর্তে কেবল মৌখিক দাবী শয়তানী চক্রের অনুসরণকে যথেষ্ট মনে করে  তাদের উক্ত ইামাম অপকটে সত্যবাক্য উচ্চারণ করে তাদের থলের বিড়াল বের করে দিয়েছে উচ্চস্বরে আমীন বলা, মহিলার মত হাত বুকে বাধাঁ, রুকুতে যাওয়া উঠার সময় হাত উত্তোলন করা এবং ইমামের পিছনে ক্বিরআত পাঠ করা এই গুটি কয়েক মাসয়ালা ব্যতিত নামায, রোযা, হজ্জ্ব, যাকাত মুয়ামালাত তথা লেনদেন অন্যান্য বিষয়ের অসংখ্য বিধিবিধান রয়েছে; যেগুলো মুসলিম জীবনে প্রতিনিয়ত জানা আমল করা একান্ত প্রয়োজন অথচ এগুলো নিয়ে বলা-বলি বা সমাধানের কোন চিন্তা-ভাবনা তাদের মাথায় নেই বলাবাহুল্য, অগণিত এই মাসয়ালা-মাসায়ির সম্পর্কে সঠিক জানা বা অনুসরণ করা মাযহাব মানা ছাড়া কখনও সম্ভব নয়
তথাকথিত আহলে হাদীসের কিছু ব্যক্তি মনে করে, হাদীস জানার জন্য সহীহ বুখারী সহীহ মুসলিম যথেষ্ট আর অন্য কোন হাদীস কিতাবের প্রয়োজন নেই আবার কেউ এমনও আছেন যারা মনে করেন শুধু সহীহ বুখারী ব্যতিত অন্য কোন গ্রন্থের হাদীস মানা যাবে না তাদের ধারণা বা দাবী মূলতঃ হাদীস অস্বীকারের নামান্তর কারণ হাজার হাজার সহীহ হাদীস রয়েছে, যা সহীহ বুখারী-মুসলিমে নেই তাই যারা বুখারী-মুসলিম শরীফ ব্যতিত অন্য হাদিস কিতাবকে অপ্রয়োজনীয় গুরুত্বহীন মনে করেন; তারা প্রকারান্তরে অসংখ্য হাদীসকে অমান্য করেন আক্ষেপের বিষয়, তাদের উক্ত দাবীর পক্ষে কোন হাদীস নেই এমনকি খোদ ইমাম বুখারী-মুসলিম থেকেও এমন উক্তি পাওয়া যায় না
অন্যান্য কিতাবের হাদীস প্রয়োজন নেই, সহীহ বুখারী-মুসলিমের হাদীসই যথেষ্ট, তাদের এই ধারণা অমূলক ভ্রান্ত সহীহ বুখারী-মুসলিম কিতাবদ্বয়ের নামের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে সহজে বুঝা যায় যে, ইমাম বুখারী ইমাম মুসলিম (.) দুজনেই স্বীয় কিতাবের নামকরণেমুখতাসারশব্দটি ব্যবহার করেছেন যেমন, ইমাম বুখারী (.) তাঁর কিতাবের নাম রেখেছেন,الجامع المسند الصحيح المختصر من أمور رسول الله صلى الله عليه وسلم وسننه وأيامه- আর ইমাম মুসলিম তার গ্রন্থের নামকরণ করেন, المسند الصحيح المختصر من السنن بنقل العدل عن العدل عن رسول الله صلى الله عليه وسلم-   মুখতাসারশব্দের অর্থ- সংক্ষিপ্ত এর দ্বারা বুঝা যায় যে, উক্ত কিতাবদ্বয়ে সকল সহীহ হাদীস সন্নিবেশিত হয়নি
এছাড়া ইমাম বুখারী ইমাম মুসলিম (.) সংকলকদ্বয়ের স্পষ্ট স্বীকৃতি রয়েছে যে, তাঁরা উক্ত কিতাবদ্বয়ে সকল সহীহ হাদিস সংকলন করেননি ইবনে আদী (.) তাঁর আল-কামিল কিতাবের ভূমিকাতে নিজস্ব সনদে ইমাম বুখারী (.) হতে বর্ণনা করেন, ইমাম বুখারী (.) বলেন, ما أدخلت فى كتابى الجامع إلا ما صحّ وتركت من الصحاح لحال الطول- অর্থাৎ: আমি আমারজামি আস-সহীহগ্রন্থে সহীহ হাদীস সংকলন করেছি তবে দীর্ঘ হওয়ার ভয়ে অনেক সহীহ হাদিস ছেড়ে দিয়েছি  এমনি করে ইমাম মুসলিম (.) বলেন,
إنما أخرجت هذا الكتاب وقلت هو صحاح ولم أقل إنّ ما لم اخرجه من الحديث فى هذا كتاب ضعيف، ولكن إنما خرجت هذا من الصحيح ليكون مجموعا عندى وعند ما يكتبه عنى ولا يرتاب فى صحته ولم أقل إنّ ما سواه ضعيف-
অর্থাৎ: আমি যে সকল হাদীস এই কিতাবে সংকলন করেছি তা সহীহ আর যে সকল হাদীস এই কিতাবে লিপিবদ্ধ করিনি; আমি বলি না সেই হাদীসগুলো যয়ীফ আমি এই কিতাব রচনা করেছি, যাতে আমার নিজের কাছে সহীহ হাদীসের একটি সংকলন থাকে এবং আমার থেকে যারা হাদীস লিখবে তারা এর বিশুদ্ধতার ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ না করেন আমি কখনই বলিনি এটি ব্যতিত অন্য হাদীস জয়ীফ
সর্ব যুগে মুসলিম উম্মার সকল বিশেষজ্ঞ সাধারণ মুসলমানগণ বরাবরই কোন না কোন একটি মাযহাবের অনুসরণ করে আসছেন দুঃখজনক হলেও সত্য যে, যাদের নিকট হাদীসের শিক্ষা-সভ্যতা, ভদ্রতা সৌজন্যতা বলতে কিছুই নেই; তাদের বিষাক্ত মনগড়া মতবাদ হীন চক্রান্ত এবং চরম বাড়াবড়ির ফলে মুসলিম সমাজে শান্তি ভঙ্গ হচ্ছে মসজিদে মসজিদে সৃষ্টি হচ্ছে- দলাদলি বিভিন্ন মতবাদ কাজেই মুসলিম উম্মাহর এই শোচনীয় ক্রান্তি লগ্নে আহলে সুন্নাতের অনুসারীগণ ঈমান জাতীয় চেতনায় উদ্ধুদ্ধ হয়ে, ঈামান-আমল রক্ষায় মাযহাব-মিল্লাতের সার্বিক অগ্রগতিতে সোচ্চার হওয়া অতীব প্রয়োজন

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন