মঙ্গলবার, ১ মার্চ, ২০১৬

নবীজীর নাম ও গুণবাচক নামের মাহাত্ম্য



নবীজীর নাম গুণবাচক নামের মাহাত্ম্য
গাজী মুহাম্মদ শরীফুল ইসলাম

পৃথিবীর সূচনালগ্ন থেকে অদ্যবধি যে মহান ব্যক্তিত্বের নাম সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে, যাকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে অসংখ্য ইতিহাস, রচনা, প্রবন্ধ, কবিতা, না শরীফ, তিনি হলেন মানবতার মহান পরম বন্ধু এবং আমাদের প্রাণের আক্বায়ে মাওলা নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তাআলা আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়াসাল্লাম স্বয়ং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তাঁর প্রিয় হাবিবের নামকে সুউচ্চ মিনারের সর্বোচ্চ চূড়ায় স্থান দিয়েছেন তাইতো আল-কুরআনে তাঁর নাম উল্লেখ করে তাঁকে মর্যাদার আরো উচ্চশিখরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে আল্লাহ তাআলা বলেন- আর আমি আপনার জন্য আপনার স্মরণকে সমুন্নত করেছি অর্থ্যাৎ যখন আমাকে স্মরণ করা হবে, তখন আমার সাথে আপনাকেও স্মরণ করা হবে
কুরআন-সুন্নায় আলোচিত নবীজীর নাম কতিপয় গুনবাচক নামের মাহাত্ম্য:
. মুহাম্মাদ: মুহাম্মাদ অর্থ প্রশংসিত আরবীমুহাম্মদশব্দটির মূল ধাতূ হচ্ছেহা’ ‘মীম’ ‘দালঅর্থ্যাৎ হামদুন হামদুন শব্দের অর্থ প্রশংসা, সন্তুষ্টি, কৃতজ্ঞতা, প্রতিদান, হক আদায় করা ইত্যাদি আর হামদুন থেকেইতাহমীদগঠিত এর অর্থ হলো সদাসর্বদা প্রশংসা করা হয় সুতরাংমুহাম্মদশব্দটির অর্থ হলো সদাসর্বদা যার প্রশংসা করা হয় আল-কুরআনে নামটি চার বার এসেছে যেমন সূরা আলে ইমরান-১৪৪, সূরা আহযাব-৪০, সূরা মুহাম্মাদ-, সূরা আল ফাতাহ-২৯ নং আয়াত
. আহ্মাদ: আহমদ শব্দের দুটি অর্থ ().‘অধিক প্রশংশিত’, আল্লাহর বান্দার মধ্যে যিনি সবচেয়ে বেশি প্রশংসার যোগ্য ().আল্লাহ্র সর্বাধিক প্রশংশাকারী আর নামটি আল-কুরআনে একবার এসেছে যথা আল্লাহ পাক বলেন- এবং স্মরণ করুন! যখন মারয়াম-তনয় ঈসা বললো, হে বনী ইসরাঈল! আমি তোমাদের প্রতি আল্লাহরই রাসূল, আমার পূর্বেকার কিতাব তাওরাতের সত্যায়নকারী, এবং সম্মানীত রসূলের সংবাদদাতা হয়ে, যিনি আমার পরে তাশরীফ আনবেন, তাঁর নামআহ্মাদ হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম আরো বলেছিলেন যে, যদি রাজ্য পরিচালনার দায়িতা¡বলী না থাকতো, তবে আমি হুজুরের দরবারে হাযির হয়ে তাঁর জুতা মোবারক বহনের সেবাই আঞ্জাম দিতাম
. নবী: ‘নাবাশব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ সংবাদ রাসূল সাল্লাল্লাহু তাআলা আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়াসাল্লাম আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে তাঁর বাণী পৃথিবীর মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন কোন পথে মানুষের মুক্তি এবং কোন পথে শয়তান ফাঁদ পেতে বসে আছে এমন অসংখ্য পথ মতের মধ্যে তিনি সঠিক পথের সংবাদবাহক নবীর ইংরেজী শব্দ হচ্ছেচৎড়ঢ়যবঃচৎড়ঢ়যবঃশব্দটি চৎড়ঢ়যবপু হতে উৎপত্তি হয়েছে, যার অর্থ হচ্ছে ভবিষ্যতবাণী আল্লাহ্ প্রদত্ত গায়েবের সংবাদদাতাকে নবী বলা হয়
. রাসূল: এর অর্থ হচ্ছে দূত বা বার্তাবাহক হে মাহবুব! আমি আপনাকে সমস্ত মানুষের জন্য রসূলরূপে প্রেরণ করেছি
. মুয্যাম্মিল: চাদর আবৃত ব্যক্তি আল্লাহ পাক বলেন- হে বস্ত্রাবৃত! অর্থ্যাৎ আপন বস্ত্র দ্বারা নিজেকে আবৃতকারী মুফাস্সীরগণ বলেছেন- হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু তাআলা আলাইহি ওয়ালিহী ওয়াসাল্লাম চাদর শরীফ বরকতময় গায়ে দিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন এমতাবস্থায় তিনির কাছে জিব্রাঈল (আঃ) ওহী নিয়ে এসে আহ্বান করলেন يا ايها المزمل)হে বস্ত্রাবৃত!(
. মুদ্দাসসির: বস্ত্র মুড়ি দিয়ে শয়নকারী আল্লাহ তাআলা বলেন- হে বস্ত্র মুড়ি দিয়ে শয়নকারী ! দন্ডয়মান হয়ে যান, অতঃপর সতর্ক করুন সম্প্রদায়কে আল্লাহর শাস্তি থেকে ঈমান না আনার উপর এবং আপন প্রতিপালকের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করুন
. শাহিদ: এর অর্থ হলো সাক্ষ্যদাতা হে অদৃশ্যের সংবাদদাতা (নবী) ! নিশ্চয় আমি আপনাকে প্রেরণ করেছি সাক্ষ্যদাতা হিসেবে অর্থ্যাৎ শাহেদ এর অনুবাদউপস্থিত-পর্যবেক্ষনকারী’ (হাযির-নাযির) উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম রাগেব বলেন- ঘটনার স্থলে প্রত্যক্ষভাবে দেখার সাথে হাযির থাকা- চাই সেই দেখা কপালের চোখে হোক কিংবা অন্তরের চোখে হোক আরসাক্ষীকেও এজন্য (شاهد) বলা হয়, যেহেতু সাক্ষী স্বচক্ষে অবলোকনের মাধ্যমে যেই জ্ঞান রাখে তা বর্ণনা করে থাকে
. বাশির মুবাশ্বির: সুসংবাদদাতা হে নবী আমি আপনাকে প্রেরণ করেছি সুসংবাদদাতা সতর্ককারীরূপে
অর্থ্যাৎ ঈমানদারদেরকে জান্নাতের সুসংবাদ কাফেদেরকে জাহান্নামের শাস্তির ভয় শুনান মূলত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু যআলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পয়গাম ছিল মানবজাতির জন্য অনেক বড় শুভসংবাদ
. নূর অর্থ হলো আলো নিশ্চয় তোমাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে একটানূরএসেছে এই নূর দ্বারা হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বুঝানো হয়েছে প্রকৃত পক্ষে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আগমনে অন্ধকার দূরীভূত হয়ে যায় তাঁর শিক্ষা এবং চরিত্র, আচার-ব্যবহার যেমন ছিল আলোকিত ঝলমল, তেমনি তাঁর বাস্তব অবয়বও ছিল সূর্য ঝিকমিক প্রিয় নবীর দৈহিক সৌন্দর্য সম্পর্কে রাবী কুলের ¤্রাট হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চেয়ে সুদর্শন কাউকে দেখিনি আমরা হুজুরের চেহরা মোবারক থেকে আলো বিকীর্ণ হতে দেখেছি মনে হতো যেন সূর্য ঝিকমিক করছে
১০. মুনজির নাজির: ভীতি প্রদর্শনকারী অর্থ্যাৎ এখনো যারা সত্য সস্পর্কে অজ্ঞ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন তাদের সতর্ক সাবধানকারীহে নবী আমি আপনাকে পাঠিয়েছি ভয় প্রদর্শনকারী হিসেবে অর্থ্যাৎ যারা কাফের, মুনাফিক এবং দোষমনে রাসূল, তাদের জন্য জাহান্নামের শাস্তির ভয় শুনান
১১. আল-আমিন: এর অর্থ হলো-বিশ্বস্ত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উন্নত চরিত্র মাধুর্যমন্ডিত স্বভাবের কারণে স্বতন্ত্র এবং বিশিষ্ট ছিলেন তিনি ছিলেন একজন সম্মানিত প্রতিবেশি, বন্ধুভাবপন্ন, সর্বাধিক দূরদর্শিতা সম্পন্ন জ্ঞানী, সত্যবাদী, কোমল প্রাণ পবিত্র পরিচ্ছন্ন মনের অধিকারী অঙ্গীকার পালনে, প্রতিশ্রুতি রক্ষায় আমানত আদান-প্রদানে তিনি ছিলেন অতুলনীয়তাই স্বজাতির লোকেরা (কার্ফেরা) তাঁহাকেআল-আমিননামে ভূষিত করেছেন

১২. দাঈইলাল্লাহ: আল্লাহর দিকে আহবানকারী এবং আল্লাহর প্রতি তাঁর নির্দেশে আহ্বানকারী অর্থ্যাৎ পথভ্রষ্ঠ লোকদেরকে আল্লাহর ক্ষমতার দিকে আহবানকারী প্রিয় পাঠক বন্ধুরা! দেখুন, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দিশেহারা মানুষকে আল্লাহর দিকে দাওয়াত করে আজ শান্তির বাণী সমগ্র বিশ্বে পরিপূর্ণ করেছেন
১৩. হাদী: পথপ্রদর্শক রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সিরাতুল মুস্তাকিমের পথপ্রদর্শক মানবজাতি যখন জাহিলিয়াতের কুলে ঘুম গিয়েছিল, সভ্যতা যখন প্রগাঢ় অন্ধকারে ডুবেছিল, চারিদিকে বিরাজ করেছিল উত্তেজনা, মানুষ-মানুষের মাঝে সংঘাত, যুদ্ধ লুটপাতের তাগুবে মেতে উঠেছিল তখন ঠিক সেই মুহুর্তে লাখো চাঁদের আলোক নিয়ে হেরা থেকে নেমে এলেন সিরাতুল মুস্তাকিমের প্রদর্শক মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
১৪. সিরাজুম মুনিরা: মূর্তিমান আলোক প্রদিপ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্ তাআলা বলেন- “হে নবী আমি আপনাকে সাক্ষ্যদানকারী, সুসংবাদদাতা, আল্লাহ্র নির্দেশে তাঁর দিকে আহবানকরী, এবং উজ্জ্বল প্রদীপ বানিয়ে পাঠিয়েছিঅর্থ্যাৎ- নবীজির ব্যত্তিত্ব জীবন আমাদের পথের অন্ধকার দূরীভূতকারী উজ্জ্বল এক আলোকবর্তিকা
১৫. রহমত‏: অনুগ্রহ আল্লাহ পাক বলেন-“হে হাবীব ! আপনি বলুন, আল্লাহরই অনুগ্রহ তাঁর দয়া, এবং সেটারই উপর তাদের আনন্দ প্রকাশ করা উচিৎ যা তাদের সমস্ত ধন-দৌলত অপেক্ষা শ্রেয়
অত্র আয়াতের তাফসীরে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন- আল্লাহর অনুগ্রহ (ফাদ্বলুল্লাহ) দ্বারা,” ইলম বা কোরআনআর তাঁর দয়া (রাহমাতিহী) দ্বারা, ”হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেবুঝানো হয়েছে কেননা আল্লাহ তাআলা সরাসরি অন্য আয়াতে বলেন- (হে নবী)! আর আমি আপনাকে জগত সমূহের প্রতি কেবল রহমত রূপে প্রেরণ করেছি
বিশ্ব মানবতা যখন ধ্বংশের দ্বার প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছিল, আকস্মাৎ আল্লাহর গজব এসে আছড়ে পড়বে হয়তো এখনি কিন্তু সেই মহুর্তে রাসূলে আকরাম, নূরে মুজাস্সাম, হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শুভাগমনের কারণে সমগ্র মানবজাতি অবশ্যম্ভাবী এক ধ্বংশ থেকে মুক্তি পেল
অতএব, যারা উম্মতের কান্ডারী দুকুলের সাথী হয়েও রাসূলে পাকের সাথে বিদ্বেষভাব রাখে, তাদেরকে আল্লাহ তাআলা সঠিক মর্ম যথার্থ উপলদ্ধি করার তাওফিক হিদায়াত দান করুক আমিন বিহুরমাতি সায়্যিদিল মুরসালিন

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন