প্রসঙ্গ:
জিয়ারত
জিশান
আহমাদ
রওজা শরীফ, মাজার শরীফ
ও মুসলমানদের কবর জিয়ারত করা
সুন্নাত। আর
সুন্নাতকে মাজার-পূজা, কবর-পূজা, শিরক ইত্যাদি
বলে অবমাননা করাটা চরম অজ্ঞতা,
গোমরাহী, বিদয়াতে সায়্যিয়াহ্ বা কুফর।
তাছাড়া, নবী-ওলীগণ মৃত্যুর
স্বাদ নিয়েও জীবিত। তাই,
তাঁদের কাছে সাহায্য চাওয়া
জায়েজ।
সাধারণত
মহামান্য নবীগণের (আলাইহিমুস সলাতু ওয়াস সালাম)
সমাধিকে “রওজা শরীফ”, সম্মানীত
ওলীআল্লাহগণের (রাদ্বিআল্লাহু তা’য়ালা ’আনহুম)
সমাধিকে “মাজার শরীফ” এবং
সাধারণ মুসলমানের সমাধিকে আরবিতে “কবর” (قبر) বলা
হয়। ফার্সী
“রওজা” শব্দটি আরবি “রাওদ্বাহ”
(روضة) থেকে এসেছে - যার
অর্থ বাগান, তৃণভূমি, উদ্যান
ইত্যাদি। আর
আরবি “মাজার” (مزار) শব্দটির অর্থ
জিয়ারত বা পরিদর্শনের জায়গা। এসব
জিয়ারত করা সুন্নত ও
নেক-আমল তথা অত্যন্ত
সওয়াবের কাজ। এতে
করে, তাঁদের সঙ্গে দুনিয়াবাসী
মুসলমানদের আত্মিক সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত
হয়। এ
সুন্নতে বাধা দেওয়া বিদয়াত,
একে কবর-পূজা বা
মাজার-পূজা বলে অবজ্ঞা
করা কুফর এবং এর
বিরুদ্ধে অপপ্রচার করা চরম অজ্ঞতা,
গোমরাহী ও বাতিলপন্থীদের কারসাজি
ও বৈশিষ্ট্য। তেমনি,
এসব জিয়ারতের নামে কোনো বেশরা
কাজ বা আচরণও কোনোভাবেই
সমর্থিত নয়, বরং নিন্দিত
ও ধিকৃত। কেননা,
এর ফলে, এ সুন্নত
বা নেক-আমলের ভাবমূর্তি
নষ্ট হয়ে ফেতনার সৃষ্টি
হয় এবং বাতিলপন্থীরা মওকা
পেয়ে যায়।
যাহোক,
নবী ও ওলীগণ মৃত্যুর
স্বাদ নিয়েও জীবিত থাকেন
এবং আল্লাহুতা’য়ালা তাঁদেরকে দুনিয়াবাসীদের
সাহায্য-সহযোগিতা করার ক্ষমতা দান
করেন। তাই,
তাঁদের কাছে সরাসরি বা
দূর থেকে কিংবা তাঁদের
রওজা বা মাজার শরীফে
গিয়ে অথবা তাঁদের উসীলায়
সাহায্য-সহযোগিতা চাওয়া নিঃসন্দেহে জায়েজ।
একটি জড় পদার্থ তথা
কৃত্রিম ভূ-উপগ্রহ (স্যাটেলাইট)
যদি মহাকাশ থেকে একই
সময়ে বিশ্বের প্রায় সকল দেশে
কোনো কিছু সম্প্রচার করতে
পারে তথা মানব জাতিকে
সাহায্য করতে পারে কিংবা
বিশ্বের পরাশক্তিগুলো যদি তাদের কৃত্রিম
ভূ-উপগ্রহগুলোর কল্যাণে সুদূর মহাকাশ থেকে
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গোয়েন্দাগিরি বা
নজরদারি কিংবা মনিটরিং করতে
পারে-তাহলে, নবী-ওলীগণ
যাঁর যাঁর রওজা ও
মাজার শরীফে থেকে কিংবা
সেখানে থেকে অতীন্দ্রিয় পন্থায়
বের হয়ে মুসলিম উম্মাহর
হাল-হাকীকত পর্যবেক্ষণ, তাদের
আবেদন শ্রবণ ও গ্রহণ
এবং তাদেরকে সাহায্য-সহযোগিতা করতে পারবেন না
কেন? তাঁদের চেয়ে কি
ঐ কৃত্রিম ভূ-উপগ্রহগুলো তথা
জড় পদার্থগুলোর ক্ষমতা বেশি (মায়াজাল্লা)?
তাছাড়া, ঐ জড় পদার্থের ব্যাপক
ও বাস্তব ক্ষমতাকে (ডড়ৎষফ
রিফব নৎড়ধফপধংঃরহম ঢ়ড়বিৎ ড়ৎ হবঃড়িৎশরহম
ঢ়ড়বিৎ) স্বীকার করলে যদি শিরক
না হয় - তাহলে, নবী-ওলীগণের অতীন্দ্রিয় বা আধ্যাত্মিক ব্যাপক
ক্ষমতাকে স্বীকার করলে শিরক হবে
কেন? মোদ্দা কথা হচ্ছে,
ওয়াহাবী, সালাফী, দেওবন্দী ও লা-মাযহাবীরা
নবী-ওলীগণের চেয়েও জড়পদার্থকে বেশি
ক্ষমতাশালী মনে করে।
তাই, ওরা নিঃসন্দেহে গোস্তাখে
রাসূল বা বেয়াদবে আওলিয়া। আর
নিষ্ঠাবান সুন্নীগণ জড়পদার্থ তথা কৃত্রিম ভূ-উপগ্রহের চেয়ে নবী-ওলীগণকে
বহুগুণ বেশি শক্তিশালী মনে করেন। তাই,
তাঁরা আশেকে রাসূল ও
আশেকে আওলিয়া। বলা
বাহুল্য, জীব ও জড়ের
সকল ক্ষমতা আল্লাহুতা’য়ালারই
দান।
প্রথমে
আম্বিয়ায়ে কেরামের (’আলাইহিমুস সালাম) ক্ষমতার প্রসঙ্গে
আসি। মহান
আল্লাহপাক ফরমান:
وَاسْأَلْ
مَنْ أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ مِنْ
رُسُلِنَا أَجَعَلْنَا مِنْ دُونِ الرَّحْمَنِ
آلِهَةً يُعْبَدُونَ
অর্থঃ
“আর আমি আপনার আগে
যাদের রাসূল হিসেবে পাঠিয়েছি-
তাদের জিজ্ঞেস করুন যে, আমি
কি রহমান ছাড়া ইবাদত
করা যায়- এমন আর
কোনো ইলাহ সাব্যস্ত করেছি?”
(যুখরুফ:৪৫)
* কামিল
ফিকহ ১ম বর্ষ।
লক্ষ্য
করুন, নবীজীর (সল্লাল্লাহুতা’য়ালা ’আলাইহি ওয়া
সাল্লাম) আগেতো প্রায় সকল
রাসূলই (’আলাইহিমুস সলাতু ওয়াস সালাম)
ইন্তেকাল করেছেন; অথচ তারপরেও আল্লাহুতা’লা তাঁকে বলছেন:
“আপনি তাঁদের (সরাসরি) জিজ্ঞেস
করুন!” এতে স্পষ্টভাবেই প্রমাণিত
হয় যে, নবী-রাসূলগণ
মৃত্যুর স্বাদ নিয়েও শুধু
জীবিতই নন, বরং তাঁরা
বারযাখী (কবরের) জীবনেও দুনিয়ার
কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িতও থাকেন। নইলে,
কেন তাঁদেরকে জিজ্ঞেস করতে তথা তাঁদের
সাহায্য নিতে বলা হলো। তাছাড়া,
তাঁরাও নবীজীকে নানাভাবে (সরাসরি বা তাঁর
উম্মতকে সাহায্য করার মাধ্যমে তাঁকে)
সাহায্য করতে প্রতিশ্রুতিবন্ধ।
যেমন- আল্লাহুতা’লা ফরমান: وَإِذْ
أَخَذَ اللَّهُ مِيثَاقَ النَّبِيِّينَ
لَمَا آتَيْتُكُمْ مِنْ كِتَابٍ وَحِكْمَةٍ
ثُمَّ جَاءَكُمْ رَسُولٌ مُصَدِّقٌ لِمَا
مَعَكُمْ لَتُؤْمِنُنَّ بِهِ وَلَتَنْصُرُنَّهُ- আর
স্মরণ করুন, যখন আল্লাহ
এ মর্মে নবীদের থেকে
অঙ্গীকার নিয়েছিলেন: “আমি তোমাদের কিতাব
ও হেকমত (প্রজ্ঞা) দেবো;
তারপর তোমাদের কাছে তোমাদের ওগুলোর
সত্যায়নকারী একজন রাসূল তাশরীফ
আনলে, তোমরা তাঁর প্রতি
ঈমান আনবে এবং তাঁকে
সাহায্য করবে।” তিনি
(আল্লাহ) বললেন:
قَالَ أَأَقْرَرْتُمْ وَأَخَذْتُمْ عَلَى ذَلِكُمْ إِصْرِي
قَالُوا أَقْرَرْنَا قَالَ فَاشْهَدُوا وَأَنَا
مَعَكُمْ مِنَ الشَّاهِدِينَ
অর্থঃ
“ আল্লাহ বলেন, তোমরা মানলেতো
এবং ঐ ব্যাপারে আমার
(দেওয়া) গুরু দায়িত্ব নিলেতো,
নাকি?” তারা বলেছিলো: আমরা
মেনে নিলাম। তিনি
(আল্লাহ) বললেন: যাক! তাহলে,
তোমরা সাক্ষী থাকো এবং
আমিও তোমাদের
সঙ্গে অন্যতম সাক্ষী থাকলাম।” (৩:৮১)
কেউ কেউ বলেন যে,
ঐ আয়াতে কারীমায় (৪৩:৪৫) পবিত্র মীরাজের
রাতে জিজ্ঞেস করতে বলা হয়েছে। কিন্তু,
এটা অন্যতম অভিমত, একমাত্র
বা সর্বসম্মত কিংবা চূড়ান্ত অভিমত
নয়, বরং এর তাফসীর
ও শানে নুযুলে এখতেলাফ
রয়েছে। তাফসীরে
ইবনে আব্বাসেও এ ব্যাপারে ৩টি
অভিমত রয়েছে - যার অন্যতমটি হচ্ছে,
“ওদের জিজ্ঞেস করুন যে, আমি
কি দয়াময় আল্লাহ্ ছাড়া
এমন কোনো ইলাহ সাব্যস্ত
করেছি - যার ইবাদত করা
যেতে পারে?” সুতরাং এ
অভিমত অনুসারে, এখানে সরাসরিই জিজ্ঞেস
করতে বলা হয়েছে।
আমাদের মনে রাখতে হবে
যে, যেসব আয়াতে কারীমার
তাফসীর ও শানে নুজুলের
ব্যাপারে সুন্নী মুফাসসিরগণ একাধিক
অভিমত দিয়েছেন - সেখানে নির্দ্বিধায় তাহকীকের
(গবেষণার) সুযোগ রয়েছে।
তাই, সেসব ক্ষেত্রে একটিমাত্র
অভিমত গ্রহণ করে বা
চাপিয়ে দিয়ে বাকিগুলোকে শিরক
বা কুফর বলাটা অবশ্যই
অজ্ঞতা। আর
তাই, এ আয়াতে কারীমার
অন্যতম তাফসীর হচ্ছে, নবীজীকে
সরাসরিই আগেকার রাসূলগণকে জিজ্ঞেস
করতে বলা হয়েছে।
যদি এটা কুফর বা
শিরক হতো - তাহলে, সুন্নী
মুফাসসিরীনে কেরাম, বিশেষ করে,
রইসুল মুফাসসিরীন ইবনে আব্বাস (রাদ্বিআল্লাহুতা’লা ’আনহু) কখনোই
এ অভিমতটি দিতেন না।
তাছাড়া, “পবিত্র মীরাজের রাতে
আম্বিয়ায়ে কেরাম যেমন সক্রিয়
ছিলেন - তেমন আর কখনো
হবেন না” - এ কথা
কে বলেছে? বরং আল্লাহুতা’য়ালা যখনি ইচ্ছে
করেন - তখনি তিনি তাঁর
নবীগণকে সক্রিয় করে থাকেন
বৈকি। এটাই
আমাদের আকীদা এবং তাঁদের
রওজা শরীফগুলো জিয়ারতের মূল হাকীকত বা
চেতনা।
দেখুন,
মৃত্যুর স্বাদ নিয়েও হযরত
মূসা (’আলাইহিস সালাম) পবিত্র মীরাজের
রাতে ৫০ ওয়াক্ত নামাজকে
৫ ওয়াক্ত নামাজ করার
পেছনে উম্মতে মুহাম্মাদীর পক্ষে
সক্রিয়ভাবে ওকালতি করে তথা
মুখ্য ভূমিকা পালন করে
প্রমাণ করেছেন যে, আম্বিয়ায়ে
কেরাম (’আলাইহিমুস সালাম) মৃত্যুর স্বাদ
নিয়েও শুধু জীবিতই নন,
বরং তাঁরা দুনিয়ার মানুষের
অফুরন্ত উপকার করতে পারেন!
এমনকি আল্লাহুতা’লা তাঁদেরকে ইসলামী
শরীয়তের মৌলিক বিষয়ে (নামাজে)
হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা পর্যন্ত
দান করেছেন, তাই না?
যারা বলেন: “ওটা মূসা
নবীর বিশেষ মু’জিজা
ছিলো” - তাদের উদ্দেশ্যে বলছি,
কোনো নবীর রওজা শরীফ
জিয়ারত করার সময়েও আমরা
এ নিয়ত করি বা
আকীদা রাখি যে, তিনি
তাঁর ঐ বিশেষ মু’জিজা দিয়েই আমায়/আমাদের সাহায্য করবেন। সর্বোপরি,
নবীজী যদি দুনিয়ার হায়াতে
থেকেই ওফাতপ্রাপ্ত রাসূলগণকে সরাসরি কিছু জিজ্ঞাসা
করতে পারেন - তাহলে, আমরা তাঁদের
রওজা শরীফগুলো জিয়ারতের সময়ে, এমনকি ঘরে
বসেও তাঁদের খেদমতে সরাসরি
সাহায্য চাইতে পারবো না
কেন? কাজেই, কোনো রওজা
শরীফে গিয়ে বা সরাসরি
নবীগণের কাছে সাহায্য চাওয়াকে
যারা শিরক বলে - তারা
আসলে শিরকের সংজ্ঞা বা
মর্মই জানে না, বরং
তারাই কুফরী, গোমরাহী ও
অজ্ঞতায় সাংঘাতিকভাবে নিমজ্জিত এবং এ নিয়ে
ফেতনা-ফ্যাসাদ সৃষ্টির মূল হোতা! মহান
আল্লাহপাক ও মহানবীজী কোথাও
বলেন নি যে, নবীগণ
ওফাতের পরে সাহায্য করতে
পারেন না, বরং এটা
ওয়াহাবী ও সালাফীদের মিথ্যাচার!
আমাদের আকীদা হচ্ছে, প্রত্যেক
নবীই হায়াতুন্নবী এবং আল্লাহুতা’লা
তাঁদের এমন ক্ষমতা দিয়েছেন
যে, তাঁরা মৃত্যুর স্বাদ
নিয়েও জীবিত এবং দুনিয়ার
কর্মকান্ডে অনায়াসে হস্তক্ষেপ করতে পারেন; যেমন-
উম্মতে মুহাম্মাদীকে হর-হামেশা সাহায্য
করার মাধ্যমে তাঁরা নবীজীকে প্রতিশ্রুতি
(৩:৮১) মোতাবেক সহায়তা
করে থাকেন।
এবার আওলিয়ায়ে কেরামের (কুদ্দিসা আসরারুহুমুল আজীজ) ক্ষমতার প্রসঙ্গে
আসি। আল্লাহুতা’লার ফরমান:
وَلاتَقولوا لِمَن يُقتَلُ في
سَبيلِ اللَّهِ أَمواتٌۚ بَل
أَحياءٌ وَلٰكِن لاتَشعُرونَ- অর্থঃ
“আল্লাহর পথে যারা জীবন
দেয় - তাদের মৃত বলো
না, বরং তারা জীবিত। কিন্তু
তোমরা তা বুঝতে পারো
না!”(২:১৫৪)
আরও এরশাদ হয়েছে: وَلاتَحسَبَنَّ الَّذينَ قُتِلوا في سَبيلِ
اللَّهِ أَمواتًاۚ بَل أَحياءٌ عِندَ
رَبِّهِم يُرزَقونَ- অর্থঃ “আল্লাহর পথে
যারা জীবন দান করে
- তাদের মৃত ভেবো না,
বরং তারা তাদের পালনকর্তার
কাছে জীবিত হিসেবে গণ্য
এবং জীবিকা পেয়ে থাকে!”
(৩:১৬৯) তাই, শহীদদের
মৃত ভাবাটা আল্লাহুতা’লার
স্পষ্ট নাফরমানি। আর
আমাদের আকীদা হচ্ছে, ওলীগণের
মর্যাদা, নবী নন - এমন
শহীদগণের উপরে। কেননা,
প্রথমত,
বান্দার হক (হক্কুল ইবাদ)
আদায় না করে কেউ
শহীদ হলে - কবরে তাকে
পাকরাও করার কথা হাদীছ
শরীফে রয়েছে। যেমন-
“ঋণ ছাড়া শহীদগণের বাকি
গুণাহ মাফ করে দেয়া
হবে” (মিশকাত শরীফ: ৩৬৩১
ও ৩৬৩২ ও মুসলিম
শরীফ)। অন্যদিকে,
বান্দার হক আদায় না
করে বা বান্দাকে কষ্ট
দিয়ে কেউ কামেল ওলী
হতে পারেন না।
আল্লাহুতা’লা ফরমান:كَلّا
إِنَّ كِتابَ الأَبرارِ لَفي
عِلِّيّين- وَما أَدراكَ ما
عِلِّيّونَ- كِتابٌ مَرقومٌ- يَشهَدُهُ
المُقَرَّبونَ- إِنَّ الأَبرارَ لَفي
نَعيمٍ- عَلَى الأَرائِكِ يَنظُرونَ-
تَعرِفُ في وُجوهِهِم نَضرَةَ
النَّعيمِ- يُسقَونَ مِن رَحيقٍ مَختومٍ-
خِتامُهُ مِسكٌ ۚ وَفي
ذٰلِكَ فَليَتَنافَسِ المُتَنافِسونَ- وَمِزاجُهُ مِن تَسنيمٍ- عَينًا
يَشرَبُ بِهَا المُقَرَّبونَ- অর্থঃ
“পক্ষান্তরে, আবরারের খাতাতো (আমলনামা) ইল্লিয়ীনে রয়েছে! আর আপনি
কি জানেন যে, ইল্লিয়ীন
কী? ওটা সুলিখিত খাতা। নৈকট্যপ্রাপ্তরা
এটা পরিদর্শন করে। আবরারতো
পরম আরামে থাকবে! (তারা)
সিংহাসনে বসে (সবকিছু) দেখবে। আপনি
তাদের চেহারায় স্বস্তির আভা দেখতে পাবেন। তাদের
অক্ষত (ইনট্যাক্ট) পানীয় খাওয়ানো হবে। এর
মহর (ছিপি) হচ্ছে, মেশক
(কস্তরী বা মৃগনাভী)! কাজেই,
এতে আগ্রহীদের প্রতিযোগিতা করা উচিত।
আর ঐ মিশ্রিত পানীয়
তাসনীম (একটি জান্নাতী ঝরণা)
থেকে উৎপন্ন। (আল্লাহুতা’লার) নৈকট্যপ্রাপ্তরা ঐ
ঝরণা থেকে খাবে!” (৮৩:১৮-২৮)
ইল্লিয়ীন
কী? ইল্লিয়ীন হচ্ছে, চিহ্নিত আমলনামা,
অর্থাৎ নেককারদের আমলনামা - যা আরশের নিচে
ও সপ্তম আকাশের উপরে
সবুজ রঙের জবরজদ পাথরের
ফলকে লিখিত। (তাফসীরে
ইবনে আব্বাস) এ সম্পর্কে আরো
মতামত রয়েছে; যেমন- ইল্লিয়ীন
হচ্ছে, সপ্তম আকাশের যেখানে
ঈমানদারদের আত্মা থাকবে, সর্বোচ্চ
আকাশ, সপ্তম আকাশ, আরশের
ডান দিকের জায়গা বা
পায়া, আরশের কাছাকাছি - যেখানে
ঈমানদারদের আত্মাগুলো (বেহেশতে যাওয়ার) অপেক্ষ করবে - যা
কিয়ামতের কঠিন আযাব থেকে
নাজাতের সূচনা, বেহেশত, সিদরাতুল
মুন্তাহার কাছাকাছি জায়গা ও আকাশে
আল্লাহুতা’লার কাছাকাছি জায়গা
(তাফসীরে তাবারী)।
আবরার
কারা? আবরার হচ্ছেন, এমন
খাঁটি ঈমানদার ও সত্যবাদী - যাঁরা
কখনো পিঁপড়ার মতো ক্ষুদ্র জীবকেও
কষ্ট দেন নি! (তাফসীরে
ইবনে আব্বাস) কিংবা আবরার হচ্ছেন,
সেসব নেককার ব্যক্তি – যাঁরা
কখনো কাউকে কোনো কষ্ট
দেন নি। তাঁরাই
ইল্লিয়ীনবাসী! (তাফসীরে তাবারী)
আসলে,
আবরার বলতে উঁচু স্তরের
বা কামেল ওলীদেরই বোঝানো
হয়েছে - যারা কাউকে কখনো
কোনো কষ্ট দেন নি
তথা বান্দার হক পুরোপুরিই আদায়
করেছেন এবং নিঃসন্দেহে তাঁরা
শহীদগণের চেয়েও উঁচু মর্তবার
অধিকারী। কেননা,
শহীদদের হক্কুল ইবাদ অনাদায়
থাকতে পারে; যেমন- ঋণ। কাজেই,
আল-কুরআন মোতাবেক, শহীদগণ
মৃত্যুর স্বাদ নিয়েও জীবিত
থাকতে পারলে, তাঁদের চেয়েও
উঁচু স্তরের যাঁরা, অর্থাৎ
আবরার তথা কামেল ওলীগণ
মৃত্যুর স্বাদ নিয়ে জীবিত
থাকতে পারবেন না কেন?
তাই, মোল্লা আলী আল-ক্বারী (’আলাইহির রাহমাহ) লিখেছেন: “লা ইয়ামূতু আওলিয়াউ”
(ওলীগণ মরেণ না - শারহে
শেফা), অর্থাৎ তাঁরা মৃত্যুর
স্বাদ নিয়েও অমর।
দ্বিতীয়ত,
আওলিয়া কারা? এর উত্তরে
নবীজী (’আলাইহিস সলাতু ওয়াস সালাম)
ফরমান: “যাদের দেখলে আল্লাহুতা’লার কথা মনে
হয়ৎ - তারাই হচ্ছে, আওলিয়া। রোজ
কিয়ামতে তাদের চেহারা নূরান্বিত
হবে, তাঁরা নূরের ভেতরে
থাকবে, আল্লাহুতা’লা নূরের আসনে
তাদের বসতে দেবেন এবং
তাঁর কাছে তাদের উঁচু
মর্তবা দেখে নবী ও
শহীদরাও ঈর্ষা করবেন।
সকল মানুষ যখন ভীত
ও চিন্তিত থাকবে - তারা তখন ভীত
ও চিন্তিত হবে না।
এরপরে তিনি তিলাওয়াৎ করলেন:
أَلاإِنَّ أَولِياءَ اللَّهِ لاخَوفٌ عَلَيهِم
وَلاهُم يَحزَنونَ“শুনে রাখো! আল্লাহর
ওলীদের কোন ভয় নেই
এবং তারা দুঃখিতও হবে
না (১০:৬২)।”
(মেশকাত, আবূ দাউদ, বাগাবী,
তাফসীরে তাবারী ও মাযহারী;
নানা সূত্রে কম-বেশি
করে বর্ণিত)
তৃতীয়ত,
আল্লাহুতালা ফরমান: مَنْ عَادَى
لِي وَلِيًّا فَقَدْ آذَنْتُهُ بِالحَرْبِ“কেউ আমার কোন
ওলীর সঙ্গে শত্রুতা করলে
- আমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ
ঘোষণা করি” (মেশকাত: ২১৫৭
ও বুখারী: ৬০৫৮) কিন্তু তিনি
শহীদদের পক্ষে এমন কোন
কথা বলেন নি!
চতুর্থত,
ইবনে তাইমিয়ার ছাত্র ইবনুল কাইয়্যিম
আল-জাওঝিয়া তার “রূহ” কিতাবের
“জীবিত ও মৃত ব্যক্তিদের
রূহ একে-অপরের সঙ্গে
দেখা হয় কী না?”
অধ্যায়ে লিখেছেন: “একজন জীবিত ও
মৃত ব্যক্তির রূহ যে একে
অপরের সঙ্গে দেখা করে
- এর বহু প্রমাণ রয়েছে। অনুভূতি
ও সত্য ঘটনাগুলোর মাধ্যমে
তা জানা যায়।
জীবিত ও মৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃৃত
ব্যক্তির রূহ এমনভাবে মিলিত
হয় - যেভাবে জীবিতরা একে
অপরের সঙ্গে মিলিত হন। ... জীবিত ও
মৃতদের রূহের মিলিত হওয়ার
এটাও একটি প্রমাণ যে,
জীবিত বুজুর্গগণ স্বপ্নে মৃতদের দেখা পান
এবং তাঁদের কাছ থেকে
তাঁদের হাল-হাকীকত জেনে
নেন। আর
মৃতরা এমন অজানা তথ্যও
জানিয়ে দেন - যেগুলোর মাঝে
ঘটে যাওয়া ঘটনাবলীও রয়েছে। কোনো
কোনো সময়ে মৃত ব্যক্তি
মাটিতে পুঁতে রাখা ধন-সম্পদের খবরও দিয়ে থাকেন
- যে সম্পর্কে তিনি ছাড়া আর
কেউ জানতেন না! কখনো
তাঁরা অন্যের ঋণের কথাও,
এমনকি ঐ ঋণের সাক্ষ্য
প্রমাণের তথ্যও জানিয়ে দেন!!
এছাড়া, কখনো দুনিয়ার কর্মকান্ড
সম্পর্কেও খবরাখবর দিয়ে থাকেন - যা
তিনি ছাড়া দুনিয়ার আর
কেউ জানেন না!!! মৃত
ব্যক্তি কখনো বলে থাকেন:
“তুমি অমুক সময়ে আমার
কাছে আসবে।” এ
খবরও সঠিক হয়ে যায়। কখনো
তিনি এমনসব তথ্যও বলে
দেন- যেসবে জীবিতদের দৃঢ়
বিশ্বাস ছিলো যে, তারা
ছাড়া বুঝি আর কেউ
তা জানতো না।
এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত
হযরত সা’য়াব, আউফ,
সাবিত ইবনে কায়েস, সদাকা
ইবনে সুলায়মান জাফরী, শুবাইব ইবনে
শাইবাহ ও ফযল ইবনে
মুয়াফফিকের (রাদ্বিআল্লাহুতা’লা ’আনহুম) ঘটনাবলী
উল্লেখযোগ্য” (এরপরে, ইবনে কাইয়্যিম
এসব সাহাবী বা নেককারের
ঘটনা একে একে বয়ান
করেছেন)। এখন
ওয়াহাবী ও সালাফীদের কাছে
আমার প্রশ্ন হচ্ছে, ইবনুল
কায়্যিম মুশরিক কী না?
নাকি, উনি আপনাদের জ্ঞাতিভাই
দেখে খাতির করবেন?
হযরত বুরাইদা (রাদ্বিআল্লাহুতা’লা ’আনহু) বলেন,
আল্লাহর রাসূল (সল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম) ফরমান: ﻛﻨﺖ ﻧﻬﻴﺘﻜﻢ
ﻋﻦ ﺯﻳﺎﺭﺓ ﺍﻟﻘﺒﻮﺭ ﻓﺰﻭﺭﻭﻫﺎ-
অর্থ: “আমি তোমাদের কবর
জিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম। এখন
থেকে জিয়ারত করো...।”
(মুসলিম শরীফ ও মিশকাত:১৬৬৮)
হযরত ইবনে মাস’ঊদ
(রাদ্বিআল্লাহুতা’লা ’আনহু) বর্ণনা
করেন, আল্লাহর রাসূল (সল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম) ফরমান: ﻛﻨﺖ
ﻧﻬﻴﺘﻜﻢ ﻋﻦ ﺯﻳﺎﺭﺓ ﺍﻟﻘﺒﻮﺭ
ﻓﺰﻭﺭﻭﻫﺎ ﻓﺎ ﻧﻬﺎ ﻧﺰﻫﺪ
ﻓﻲ ﺍﻟﺪﻧﻴﺎ ﻭﺗﺬﻛﺮﺓ ﺍﻻﺧﺮﺓ-
অর্থ: “আমি তোমাদের কবর
জিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম। এখন
জিয়ারত করো। কেননা,
এটা হচ্ছে, দুনিয়ার প্রতি
অনাসক্তি ও আখেরাতের স্মরণ।” (ইবনে
মাজা ও মিশকাত:১৬৭৫)
লক্ষ্য
করুন, “দুনিয়ার প্রতি অনাসক্তি ও
আখেরাতের স্মরণ” হচ্ছে, তাক্বওয়া
বা পরহেজগারীর প্রধানতম বৈশিষ্ট্য। সুতরাং
মুসলমানদের কবর, মাজার শরীফ
ও রওজা শরীফ জিয়ারত
করাটার নিঃসন্দেহে মুক্তাকী বা পরহেজগারীদের বৈশিষ্ট্য,
তাই না?
তাবেয়ী
হযরত মোহাম্মদ বিন নু’মান
(রাদ্বিআল্লাহুতা’লা ’আনহু) থেকে
বর্ণিত, নবীজী (সল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম) ফরমান: “প্রতি শুক্রবার কেউ
তার মা-বাবা বা
তাঁদের কারো কবর জিয়ারত
করলে - তাকে ক্ষমা করে
দেয়া হবে এবং (মা-বাবার সঙ্গে) সদাচারী
হিসেবে গণ্য হবে” (শুয়াবুল
ঈমান ও মিশকাত:১৬৭৪)। সুতরাং
স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো যে, সাধারণ
মুসলমানদের কবর জিয়ারত করা
সন্দেহাতীতভাবে পরহেজগারী, মাগফিরাতের অন্যতম উপায় এবং
মা-বাবার অনুগত সন্তান
হওয়ার অন্যতম উপায়।
খতীব বাগদাদী (’আলাইহির রাহমাহ) লিখেছেন, ইমাম শাফেয়ী (’আলাইহির
রাহমাহ) বাগদাদে থাকতে ইমামে আযম
আবূ হানীফার কবর জিয়ারত করতেন
এবং তাঁকে উসীলা করে
দোয়া করতেন। তিনি
ইমাম আবূ হানীফার মাজার
শরীফের বরকত সম্পর্কে নিজের
পরীক্ষিত আমল বর্ণনা করতে
গিয়ে বলেছেন: “আমি ইমাম আবূ
হানীফার উসীলায় বরকত লাভ
করি এবং প্রতিদিন তাঁর
কবর জিয়ারত করি।
যখন আমার কোনো প্রয়োজন
বা সমস্যা হয় - তখন
আমি দু’রাকাত নামায
আদায় করে তাঁর কবরের
কাছে এসে, এর পাশে
দাঁড়িয়ে হাজত (প্রয়োজন) পূরণের
জন্যে আল্লাহুতা’লার কাছে দোয়া
করি। এরপরে
আমি সেখান থেকে ফিরতে
না ফিরতেই আমার হাজত
পূরণ হয়ে যায়!” (সূত্র:
তারিখে বাগদাদ, ১ম খন্ড, ১২৩
পৃষ্ঠা)
হযরত ইবনে হাজার হায়তামী
(’আলাইহির রাহমাহ) লিখেছেন, ইমাম শাফেয়ী (’আলাইহির
রাহমাহ) বলতেন: “নবীজীর (’আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালাম)
পরিবার-পরিজন আমার উসীলা। আমি
আশা করি, তাঁদের উসীলায়
রোজ কিয়ামতে আমার আমলনামা আমার
ডান হাতে দেওয়া হবে।” (সূত্র:
আস-সাওয়ায়িকুল মুহরিকা, ১৮০ পৃষ্ঠা)
শায়খ আব্দুল হক দেহেলভী
(’আলাইহির রাহমাহ) লিখেছেন, ইমাম শাফেয়ী (’আলাইহির
রাহমাহ) বলেছেন: “ইমাম মূসা কাযিমের
(’আলাইহির রাহমাহ) কবর শরীফ হচ্ছে,
দোয়া কবুল হওয়ার ব্যাপারে
পরশ পাথরের মতোই পরীক্ষিত!”
(আশিয়াতুল লুমআত, ২য় খন্ড,
৯২৩ পৃষ্ঠা)।
আল্লামা
ইউসূফ নাবহানী (’আলাইহির রাহমাহ) লিখেছেন, ইমাম আহমাদ ইবনে
হাম্বল (’আলাইহির রাহমাহ) আল্লাহুতা’লার কাছে দোয়া
করার সময়ে ইমাম শাফেয়ীকে
(’আলাইহির রাহমাহ) উসীলা বানাতেন।
এতে একদিন তাঁর ছেলে
আব্দুল্লাহ অবাক হয়ে যান!
তখন ইমাম সাহেব বললেন:
“ইমাম শাফেয়ী (’আলাইহির রাহমাহ) মানুষের জন্যে সূর্য এবং
শরীরের জন্যে শেফার মতোই!!”
(সূত্র: শাওয়াহিদুল হক ফীল ইস্তিগাছাতি
বিসায়্যিদিল খালক, ১৬৬ পৃষ্ঠা)
হুজ্জাতুল
ইসলাম ইমাম গাঝালী (’আলাইহির
রাহমাহ) লিখেছেন: “আল্লাহুর ইবাদতের জন্যে দ্বিতীয় প্রকার
সফর করা হয়।
যেমন- হজ্জ্ব ও জিহাদের
জন্যে সফর ইত্যাদি।
এসব বিষয়ের ফাযাইল ও
নিয়ম-কানুন আগে বর্ণনা
করেছি। এতে
(আরো) রয়েছে, নবীগণের (’আলাইহিমুস
সালাম) কবর জিয়ারত করা। সাহাবী,
তাবেঈন ও অন্যান্য আলেম
ও ওলীর কবর জিয়ারতও
এর অন্তর্গত। যে
মহাপুরুষের সঙ্গে তাঁর দুনিয়ার
হায়াতে সাক্ষাৎ করলে বরকত পাওয়া
যায় - তাঁর ওফাতের পরে,
তাঁর কবর জিয়ারত করলেও
সেই বরকত পাওয়া যায়!
এ উদ্দেশ্যে সফর করা জায়েজ। রাসূলে
করীমের (’আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালাম)
ঐ হাদীছ শরীফ কোনোভাবেই
এর প্রতিবন্ধক নয় - যেখানে তিনি
ফরমান: তিনটি মসজিদ ছাড়া
আর কোথাও (উটের) হাওদা
বেঁধো না; যথা- মসজিদুল
হারাম, মসজিদুল আকসা ও আমার
মসজিদ (মসজিদে নবভী)।”
(ইহইয়াউ ’উলূমিদ্দীন, সফর অধ্যায়)
শায়খ আব্দুল হক দেহেলভী
(’আলাইহির রাহমাহ) লিখেছেন: “হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম মুহাম্মাদ
গাঝালী (রাহমাতুল্লাহিতা’লা ’আলাইহি) বলেছেন
যে, যেসব বুযুর্গ পার্থিব
জীবনে বরকত দান করতেন
- তাঁরা ইন্তেকালের পরেও উসীলা হওয়ার
ও বরকত দান করার
(সাহায্য করার) যোগ্যতা রাখেন। কেননা,
ইন্তেকালের পরে আত্মার অবশিষ্ট
থাকাটা হাদীছ শরীফ ও
উম্মতের ইজমার আলোকে প্রমাণিত
ও সাব্যস্ত। জীবদ্দশায়
ও ওফাতের পরে - উভয়
অবস্থায়ই আত্মা কাজ করে। শরীরের
সঙ্গে কাজের কোনো সম্পর্ক
নেই। আর
আসল কাজতো করেন আল্লাহুতা’লাই।” (সূত্র:
তাকমীলুল ঈমান, ১২২ পৃষ্ঠা)
তিনি আরো লিখেছেন: “সূফীগণ
বলেন যে, কোনো কোনো
ওলীর কাজ করার ক্ষমতা
আলমে বারঝাখেও (কবরে) রয়েছে।
তাঁদের পবিত্র আত্মা থেকে
সাহায্য-সহযোগিতা লাভ করা যায়। ...বেলায়েত
অর্থ ফানাফীল্লাহ তথা আল্লাহতে বিলীন
হয়ে যাওয়া এবং বাকাবিল্লাহ
তথা আল্লাহতে অবশিষ্ট থাকা। এটা
ওফাতের পরে, আরো পূর্ণতা
পায় এবং শক্তিশালী হয়। হৃদয়বান
ও সূক্ষ্মদর্শী বিশ্লেষকদের মতে, এটা প্রমাণিত
যে, জিয়ারতকারীদের আত্মা কবরবাসীদের আত্মা
থেকে আলো ও রহস্যের
প্রতিচ্ছবি লাভ করে।
একটি আয়নার সামনে আরেকটি
আয়না রাখলে যা হয়
আরকি! এতে প্রতিচ্ছবি পড়ে। আল্লাহর
ওলীগণের (ওফাতের পরে) মেছালী
(প্রতীকী) শরীর থাকে - যার
মাধ্যমে তাঁরা প্রকাশিত হয়ে
সাহায্যপ্রার্থীকে সাহায্য করেন। যে
এ কথা অস্বীকার কওে
- তার কাছে কোনো দলিল-প্রমাণ নেই।”
(সূত্র: প্রাগুক্ত, ১২২-১২৩ পৃষ্ঠা)
তিনি আরো লিখেছেন, জনৈক
বুযুর্গ বলেন, আমি এমন
চারজন বুযুর্গ দেখেছি - যাঁরা তাঁদের পার্থিব
জীবনের চেয়ে কবরে গিয়ে
আরো বেশি ক্ষমতা প্রয়োগ
করেছেন। তাদের
মাঝে খাজা মারূফ কারখী
ও শেখ আব্দুল কাদির
জিলানী (রাদ্বিআল্লাহুতা’য়ালা ’আনহুমা) রয়েছেন। সায়্যিদ
আহমাদ মারঝুক বলেন, জীবিতদের
চেয়ে ওফাতপ্রাপ্ত বুযুর্গের সাহায্য বেশি শক্তিশালী।
ওলীগণের নিয়ন্ত্রণ সব জগতেই রয়েছে। এ
ক্ষমতা হচ্ছে, তাঁদের রূহগুলোর। আর
রূহগুলো অবিনশ্বর ও স্থায়ী।”
(সূত্র: আশিয়াতুল লুমুয়াত, কবর জিয়ারত অধ্যায়)
বড়পীর
সাহেবের (রাদ্বিআল্লাহুতা’লা ’আনহু) সবচেয়ে
বিশ্বস্ত জীবনী বাহজাতুল আসরার
ওয়া মা’দিনুল আনওয়ারে
রয়েছে, গ্রন্থকার ইমাম আবূল হাসান
আলী শাত্বনুফী শাফেয়ী (’আলাইহির রাহমাহ) লিখেছেন: “আমি এমন চারজন
শাইখকে দেখেছি - যাঁরা তাঁদের কবর
থেকে এমনভাবে ক্ষমতা প্রয়োগ করেন
- যেভাবে জীবিতরা করে থাকেন! তাঁরা
হলেন, শাইখ আব্দুল কাদির
জিলানী, মারূফ কারখী, আকীল
মানজারী ও হায়াত ইবনে
কাইস হাররানী (রাদ্বিআল্লাহুতা’লা ’আনহুম)।”
وَابتَغواإِلَيهِ
الوَسيلَةَ “তাঁর (আল্লাহুতা’য়য়ালার)
পানে ওসীলা তালাশ করো”
(৫:৩৫) এ আয়াতে
কারীমার ব্যাখ্যায় ইমাম সাবী (আলাইহির
রাহমাহ) লিখেছেন: “আল্লাহ ছাড়া আর
কারো এবাদত-বন্দেগী করছেন”
- মর্মে ধুয়া তুলে আওলিয়ায়ে
কেরামের মাজার শরীফ জিয়ারতকারীদের
কাফের আখ্যা দেয়াটা স্পষ্ট
গোমরাহী। তাঁদের
মাজার শরীফ জিয়ারত করা
মানে হচ্ছে, আল্লাহ ছাড়া
অন্য কারো এবাদত-বন্দেগী
করা নয়, বরং এটা
হচ্ছে, আল্লাহ যাঁদের ভালোবাসেন-
তাঁদেরকে ভালোবাসারই নিদর্শন” (তাফসীরে সাবী, ১ম খন্ড,২৪৫ পৃষ্ঠা)।
ওয়াহাবী
মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা ও সালাফীদের গুরু
ইবনে তাইমিয়াকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো:
নবীজীকে (সল্লাল্লাহুতা’লা ’আলাইহি ওয়া
সাল্লাম) উসীলা বানানো জায়েজ
কিনা? সে উত্তর দিয়েছিলো:
“আল-হামদুল্লিাহ! তাঁর প্রতি ঈমান
রেখে, তাঁর মুহব্বত, তাঁর
আনুগত্য, তাঁর প্রতি দরূদ
ও সালাম, তাঁর শাফায়াত,
তাঁর সুন্নতগুলোর অনুসরণ এবং তাঁর
কল্যাণে বান্দাদের জন্যে যেসব আমল
আবশ্যক হয়েছে (ফরজ-ওয়াজিব)
- সেসবকে উসীলা বানানো মুসলমানদের
ঐকমত্যে শরীয়তসম্মত।” (সূত্র:
ইবনে তাইমিয়ার আল-ফতোয়া আল-কুবরা, ১ম খন্ড,
১৪০ পৃষ্ঠা)
ইবনে তাইমিয়া আরো লিখেছে: “সাহাবায়ে
কেরাম (রাদ্বিআল্লাহুতা’লা ’আনহুম) হুজুরের
(সল্লাল্লাহুতা’লা ’আলাইহি ওয়া
সাল্লাম) পবিত্র
হায়াতে তাঁকে উসীলা বানাতেন
এবং তাঁর বেছাল মুবারকের
পরে, তাঁরা তাঁর চাচা
ইবনে আব্বাসের (রাদ্বিআল্লাহুতা’লা ’আনহু) উসীলা
ধরেছেন - যেভাবে তাঁরা হুজুরের
(সল্লাল্লাহুতা’লা ’আলাইহি ওয়া
সাল্লাম) উসীলা ধরতেন।”
(সূত্র: মাজমু’য়ায়ে ফতোয়া,
১ম খন্ড, ১৪০ পৃষ্ঠা)
সে আরো লিখেছে: “আমরা
বলি, যখন আল্লাহর কাছে
প্রার্থনাকারী বলে যে, আমি
তোমার কাছে অমুকের উসীলায়
এবং অমুক ফেরেশতা, নবী,
নেককার প্রমুখের উসীলায় কিংবা অমুকের
মর্যাদা বা অমুকের সম্মানের
উসীলায় প্রার্থনা করছি - তখন এ
দোয়ার অর্থ হচ্ছে, আল্লাহর
কাছে তাঁদের (বিশেষ) মর্যাদা রয়েছে। আর
এভাবে দোয়া করাটা বিশুদ্ধ
(ওয়া হাযা সহীহ)।
কেননা, আল্লাহর কাছে তাঁদের (বিশেষ)
মর্তবা, মর্যাদা ও সম্মান রয়েছে। আর
তাই, আল্লাহ তাঁদের দরজাকে
(স্তর) সমুন্নত করবেন, তাঁদের শ্রেষ্ঠত্ব
বাড়িয়ে দেবেন এবং তাঁরা
শাফায়াত (সুপারিশ) করলে - তিনি তা
কবুল করবেন; যেমনটি আল্লাহ
সুবহানাহুতা’লা বলেছেন যে,
তাঁর অনুমতি ছাড়া কে
তাঁর কাছে শাফায়াত (সুপারিশ)
করতে পারে?” (সূত্র: প্রাগুক্ত, ২১১
পৃষ্ঠা)
ওয়াহাবী
মতবাদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠাতা মুহম্মদ বিন ’আব্দিল ওয়াহাব
নজদীকে যখন সুন্নী উলামায়ে
কেরাম তাঁর বদ-আকীদা
ও কুকীর্তির জন্যে দোষী করলো
- তখন সে আত্মপক্ষ সমর্থন
করে লিখেছে: “সুলাইমান বিন সুহাইল এমন
কিছু ব্যাপারে আমাকে মিথ্যামিথ্যি অভিযুক্ত
করেছে - যা আমি বর্ণনা
করি নি, বরং এসবের
অধিকাংশ আমার ধারণায়ও ছিলো
না। যেমন-
আমি নাকি নেককারদের উসীলা
করাকে কুফরি বলেছি, আমি
নাকি (নবীজীকে) “ইয়া আকরামাল খালক”
বলার কারণে ইমাম বুসীরীকে
কাফের বলেছি এবং আমি
নাকি দালাইলুল খাইরাত পুড়িয়ে দিয়েছি!
এসব অভিযোগের বিরুদ্ধে আমার উত্তর হচ্ছে,
সুবহানাকা! হাযা বুহতানুল ’আযীম!!
অর্থাৎ হে আল্লাহ! তোমারই
পবিত্রতা ঘোষণা করে বলছি,
এসব জলজ্যান্ত মিথ্যে কথা!! (সূত্র:
মুহম্মদ ইবনে ’আব্দিল ওয়াহাব
নজদীর ১ ও ১১নং
রিসালার ১২ ও ৬৪নং
পৃষ্ঠা)
মাজার
শরীফ জিয়ারতকে যারা কবর-পূজা
বলে - তারা অহরহ তাদের
এ গোমরাহীর সমর্থনে একটি হাদীছ শরীফ
পেশ করে তার অপব্যাখ্যা
করে থাকে। সেটি
হচ্ছে, হযরত আবূ সাঈদ
খুদরী (রাদ্বিআল্লাহুতা’লা ’আনহু) বলেন,
আল্লাহর রাসূল (সল্লাল্লাহুতা’লা
’আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফরমান:
“তিনটি
মসজিদ ছাড়া আর কোথাও
(উটের) হাওদা বেঁধো না;
যথা- মসজিদুল হারাম, মসজিদুল আকসা
ও আমার মসজিদ।”
(মিশকাত: ৬৪২, বুখারী ও
মুসলিম)
আসুন!
হাদীছ শরীফটি নিয়ে একটু
বিশ্লেষণ করি:-
প্রথমত,
এটি একটি মানসূখ বা
রহিত হাদীছ শরীফ।
নাসেখ বা রহিতকারী দু’টি হাদীছ শরীফ
আগেই পেশ করেছি - যেখানে
নবীজী (’আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালাম)
ফরমান: “আমি তোমাদের কবর
জিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম। এখন
থেকে জিয়ারত করো।”
(মিশকাত: ১৬৬৮ ও ১৬৭৫)
দ্বিতীয়ত,
এ হাদীছ শরীফে রওজা
শরীফ, মাজার শরীফ ও
মুসলমানদের কবর জিয়ারতের কোনো
কথাই নেই। আর
তাই, এটিকে কবর জিয়ারতের
সঙ্গে গুলিয়ে ফেলাটা চরম
অজ্ঞতা ও হাস্যকর তথা
গোমরাহী।
তৃতীয়ত,
ঐ নিষেধাজ্ঞা শুধু অন্যান্য মসজিদের
ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। নইলে,
ঐ ৩টি মসজিদ ছাড়া
আর কোথাও যাওয়ার উদ্দেশেতো
বাড়ী থেকেই বের হওয়া
যাবে না! যেমন- বাজার,
অফিস-আদালত, ব্যবসা কেন্দ্র
স্কুল-কলেজ-মাদরাসা-বিশ্ববিদ্যালয়,
হাসপাতাল, শ্বশুর বাড়ী, বিয়াইয়ের
বাড়ী তথা আর কোথাওতো
তাহলে যাওয়া যাবে না,
তাই না?
চতুর্থত,
একটি হাদীছ শরীফ দিয়ে
আরেকটি হাদীছ শরীফকে ব্যাখ্যা
করাই উত্তম ব্যাখ্যা।
মুসনাদে আহমাদে উল্লিখিত হাদীছ
শরীফটি আরেকটু বিস্তারিতভাবেই রয়েছে
- যা অনায়াসে আলোচ্য হাদীছ শরীফটির
ব্যাখ্যা হতে পারে; যেমন-
হযরত আবূ সাঈদ খুদরী
(রাদ্বিআল্লাহুতা’লা ’আনহু) বলেন,
আল্লাহর রাসূল (সল্লাল্লাহুতা’লা
’আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফরমান:
“মসজিদুল হারাম, মসজিদুল আকসা
ও মসজিদে নবভী - এ
৩টি মসজিদ ছাড়া অন্য
কোনো মসজিদে নামাজ আদায়ের
উদ্দেশে সফর করা মুসাফিরের
জন্যে সঙ্গত নয় (মুসনাদে
আহমাদ:১১৬০৯)।” সুতরাং
এটা দিবালোকের মতোই পরিষ্কার হয়ে
গেলো যে, ঐ নিষেধাজ্ঞা
অন্যান্য মসজিদে বেশি সওয়াবের
উদ্দেশে সফর করার বেলায়ই
প্রযোজ্য; মাজার শরীফ বা
কবর জিয়ারতের ক্ষেত্রে মোটেও প্রযোজ্য নয়।
যাহোক,
কৃত্রিম ভূ-উপগ্রহগুলো বা
এসবের কেন্দ্রগুলো যেমন একেকটি পাওয়ার
হাউজ - তেমনি, প্রতিটি রওজা
শরীফ, মাজার শরীফ ও
নেককার মুসলমানদের কবরগুলোও একেকটি আধ্যাত্মিক কেন্দ্র
বা রূহানী পাওয়ার হাউজ
- যেগুলোর অতীন্দ্রিয় বা গায়েবী ক্ষমতা
অচিন্তনীয়! আর আল্লাহুতা’লা
সন্দেহাতীতভাবে তাঁর প্রিয়পাত্রদের তথা
নবী-ওলীগণকে জড় পদার্থের চেয়েও
অনেক বেশি ক্ষমতা দিয়ে
থাকেন - যে ব্যাপারে বাতিলপন্থীদের
কোনো ধারণাই নেই!! সুতরাং
ইসলামে মাজার-পূজা বা
কবর-পূজা বলে আসলেই
কিছু নেই। এসব
নির্বোধ ও কাট্টা বেদয়াতীদের
বিকৃত মস্তিষ্কজাত বা ওদের মাথার
ভেতরে থাকা গোবর থেকে
উদ্ভূত বেদয়াতী শব্দ বা পরিভাষা
বৈকি! কখনো কোনো মুসলমান
জিয়ারতকারী কবর বা মাজার
শরীফে শায়িত ব্যক্তিকে খোদা,
ইলাহ বা মা’বুদ
বলে মনে করেন না,
বরং আল্লাহ, ইলাহ বা মা’বুদের নেককার বান্দা
বা ওলী বলেই বিশ্বাস
করেন। কাজেই,
যারা সুন্নতকে মাজার-পূজা বা
কবর-পূজা বলে - তারা
নিঃসন্দেহে গোমরাহ, ইবলিশের দোস্ত ও আসফালু
সাফিলীনের বাসিন্দা। আল্লাহুতা’লা এসব অর্বাচীন
থেকে দ্বীন ও মিল্লাতকে
হেফাজত করুক।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন