জশনে জুলুস প্রবর্তনে আল্লামা
তৈয়্যব শাহ্ এর অবদান
হাফেজ
নূর মুহাম্মদ
প্রারম্ভিকা:
মহান আল্লাহ পাক রাব্বুল
আলামীন তাঁর প্রিয় হাবীব
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
এর শুভাগমনকে কেন্দ্র করে সমগ্র জগৎ
সৃজন করেছেন। তাই
আল্লাহ তায়ালার শোকরিয়া আদায় স¦রূপ
অসংখ্য দরূদ ও সালামের
নজরানা পেশ করছি বিশ্বনবী
হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
এর নূরাণী দরবারে।
পৃথিবীতে
মহান আল্লাহ তায়ালা মানবজাতিকে
যতগুলো নিয়ামত দান করেছেন,
তন্মধ্যে “ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম” হচ্ছে
জগৎবাসীর জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ একটি
নিয়ামত। আর
রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়া সাল্লাম এর আগমনের দিন
কেবল ঈমানদারদের জন্যই নয়, বরং
সৃষ্টিজগতের সকলের জন্য আনন্দের
ও রহমতের দিনও বটে। সুতরাং
এ শ্রেষ্ঠ নিয়ামত প্রাপ্তিতে সেই
নিয়ামতের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ
করার জন্য স্বয়ং আল্লাহ
পাক কুরআনে মাজীদে নির্দেশ
প্রদান করে বলছেন- قُلْ
بِفَضْلِ اللَّهِ وَبِرَحْمَتِهِ فَبِذَٰلِكَ
فَلْيَفْرَحُوا هُوَ خَيْرٌ مِّمَّا
يَجْمَعُونَ
আর্থাৎ
হে রাসুল ! আপনি বলুন আল্লাহর
দয়া ও রহমতকে কেন্দ্র
করে তারা যেন আনন্দ
করে এবং এটা হবে
তাদের অর্জিত সকল কর্মফলের
চেয়ে শ্রেষ্ঠ।
এরই ফলশ্রুতিতে প্রতি বছর রবিউল
আউয়াল মাসে সারা বিশ্বের
অগণিত নবী প্রেমিক মুসলমানগণ
অত্যন্ত ভক্তি ও ভাব
গাম্ভীর্যের সাথে ঈদে মিলাদুন্নবী
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
উদযাপন করে আসছেন।
তথাপি এটি একটি শরীয়ত
সম্মত পূণ্যময় আমল; যা কুরআন-সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত।
“ঈদে মিলাদুন্নবী” শব্দটি যৌগিক শব্দ। এটি
তিনটি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত। ১.
ঈদ ২. মিলাদ ৩.
নবী।
প্রথমত
‘ঈদ’ঃ ঈদ শব্দটি
আরবী। এর
শাব্দিক অর্থ হচ্ছে- আনন্দ,
উৎসব, খুশি।
বিশ্ববিখ্যাত
অভিধান প্রনেতা ইবনু মানযুর বলেন-
“সমবেত হওয়ার প্রত্যেক দিনকে
ঈদ বলা হয়”।
মুফতি
আমীমুল ইহসান রহমাতুল্লাহি আলাইহি
বলেন- “কোন মর্যাদাবান ব্যক্তিকে
স্বরণের দিন বা সমবেত
হওয়ার দিনকে ঈদের দিন
বলা হয়”।
দ্বিতীয়ত
‘মিলাদ’ ঃ মিলাদ শব্দটি
আরবী, যার শাব্দিক অর্থ-
জন্মকাল, জন্মদিন। আরবী
ভাষায় কারো জন্মদিন অর্থে
‘মাওলিদ’ বা ‘মওলুদ’ শব্দসমূহ
ব্যবহার হয়ে থাকে।
তৃতীয়ত
‘নবী’ ঃ আরবীতে নবী
শব্দটি ‘নাবা’ থেকে এসেছে। এর
অর্থ হচ্ছে- গায়েব তথা
অদৃশ্যের সংবাদ প্রদানকারী।
এখানে নবী বলতে হযরত
মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামাকে
বুঝানো হয়েছে। সুতরাং
“ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম”
এর অর্থ হচ্ছে- নবী
করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র আগমন উপলক্ষে
আনন্দ উদ্যাপন করা।
জশনে জুলুস এর অর্থ:
ফার্সিতে “জশন” শব্দের অর্থ-
খুশি বা আনন্দ উদ্যাপন
করা। আর
“জুলুস” শব্দটি “জলসা” শব্দের বহুবচন;
যার অর্থ বসা, উপবেশন,
পদযাত্রা। সুতরাং
ফার্সী “জশনে জুলুস” বিশেষ
কোন উৎসব বা আনন্দ
উদযাপন উপলক্ষে শোভাযাত্রা ইত্যাদিকেই বুঝায়।
ইসলামী
সংস্কৃতি ও ঈদে মিলাদুন্নবী
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উদযাপন
:
বর্তমানে
ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
নি:সন্দেহে সুন্দর ও রুচিপূর্ণ
ইসলামী সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে।
মিলাদুন্নবী জুলুস উদযাপনে যখন
জমায়েত ও সমাবেশ করা
হয়, শোভাযাত্রা ও পদযাত্রায় মুখরিত
হয়, তখন তা বিশেষভাবে
প্রভাবিত করে নবী
প্রেমিকের প্রেমের ঢেউকে। এটি
আধুনিক মুসলিম সমাজে জশনে
জুলুসে ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামে পরিচিতি লাভ
করে ।
সৃষ্টির
উৎস, সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ, সৃষ্টির কেন্দ্র আলোর প্রথম উদ্ভাস
ও সিরাজুম মুনিরা পৃথিবীতে আগমন
দিবসই পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা’র মূল উদ্দেশ্য
বা উপলক্ষ। আর
এ উপলক্ষ্যের চেয়ে সুন্দর, উত্তম
ও শ্রেষ্ঠ কোন উপলক্ষ নেই
নিঃসন্দেহে।
এ উপলক্ষে গৃহীত কর্মসূচীর মধ্যে
কোথাও কোন অকল্যাণ ও
অসুন্দরের নুন্যতম ইঙ্গিত নেই।
সর্বস্তরের মুসলিম লোক এ
মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাহফিলের
মাধ্যমে নবীর আদর্শ চর্চা
ও অনুশীলন করার সুযোগ পায়। বর্তমানে
পাশ্চাত্য, ভারতীয় ও বিজাতীয়
সংস্কৃতি মুসলিম সমাজকে দারুনভাবে
কলুষিত করছে। ইসলামী
আদর্শের স্থলে স্থান করে
নিয়েছে এসব কুরুচি ও
অশ্লীল সংস্কৃতি। তবে
এসব উপলক্ষ ও সংস্কৃতিতে
কোন মুক্তি ও
নাজাতের গ্যারান্টি নেই। বিশ্বনবী
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা’র অনুপম ও
অনন্য আদর্শই একমাত্র ইহকালীন
শান্তি ও পরকালীন মুক্তির
নিশ্চয়তা দিতে পারে।
কেননা তার আদর্শ ও
চরিত্রই সর্বোত্তম শ্রেষ্ঠত্ব ও অনন্যতার মূর্ত
প্রতীক। এ
প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ ইরশাদ
ফরমান- لَّقَدْ كَانَ لَكُمْ
فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ
حَسَنَةٌ - অর্থাৎ নিশ্চয়ই তোমাদের
জন্য আল্লাহর রাসূলের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা
মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।
জশনে জুলুস প্রবর্তনে আল্লামা
সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যেব শাহ রহমাতুল্লাহি আলাইহির
অবদানঃ
আল্লাহ
রাব্বুল আলামীন প্রত্যেক শতাব্দীতেই
এক বা একাধিক সংস্কারক
অলী প্রেরণ করেন; যারা
দিশেহারা মানব গোষ্ঠীকে দ¦ীনের সঠিক পথ
ও মত প্রদর্শন সহ
দ¦ীনি কল্যাণার্থে কুরআন-সুন্নাহ অনুযায়ী এমন সব সংস্কার
গ্রহণ করেন, যা পরবর্তীতে
উম্মতে মুহাম্মদী’র আক্বীদা ও
আমলের ক্ষেত্রে এক নতুন বিপ্লবের
সূচনা হয়।
নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- নিশ্চয়ই
আল্লাহ তায়ালা এ উম্মতের
জন্য প্রতি শতাব্দির শুরুতে
এমন এক ব্যক্তিকে প্রেরণ
করেন, যিনি এ দ্বীনকে
উম্মতের জন্য সংস্কার করেন।
ইসলামী
চিন্তাবিদ ও বিজ্ঞ ঐতিহাসিকদের
বর্ণনায় জানা যায়- ইসলামের
প্রথম মুজাদ্দিদ হলেন হযরত ওমর
বিন আব্দুল আজিজ রহমাতুল্লাহি
আলাইহি। এভাবে
মুজাদ্দিদ এর ধারাবাহিকতায় ১৫
তম (পঞ্চদশ) স্থানে সমাসীন হয়েছেন
আওলাদে রাসুল, গাউছে জামান
আল্লামা সৈয়্যদ আহমাদ শাহ
সিরিকোটি রহমাতুল্লাহি আলাইহি’র একমাত্র
সুযোগ্য আওলাদ গাউছে জামান
আল্লামা হাফেজ কারী সৈয়্যদ
মুহাম্মদ তৈয়্যেব শাহ রহমাতুল্লাহি আলাইহি। তিনি
তার শ্রদ্ধেয় আব্বাজান সৈয়দ আহমদ শাহ
রহমাতুল্লাহি আলাইহি’র আদর্শে
গড়ে উঠে কুরআন হাদীসের
সঠিক রূপ রেখায় অনেক
সংস্কার কর্মসূচি হাতে নিয়ে তাতে
পূর্ন সফলতা অর্জন করেছেন। এসব
সংস্কারমূলক কাজের মধ্যে অন্যতম
হল জশনে জুলুমে ঈদে
মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ।
১৯৭৪ সালে স্বাধীনত্তোর কালে
বাংলাদেশে তিনি তখনো তাশরীফ
আনেননি। পাকিস্তানের
সিরিকোট শরীফ থেকে চট্টগ্রামে
আঞ্জুমানে রহমানিয়া আহমাদিয়া সুন্নিয়া কর্মকর্তাদের চিঠি মারফত নির্দেশ
দিলেন ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম উদযাপন উপলক্ষে জশনে
জুলুস এর আয়োজন করতে। উল্লেখ্য
যে, এ চিঠিতে জশনে
জুলুস কী এবং কিভাবে
পালন করা হবে, এর
ব্যাপারে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনাও জানিয়ে
দিয়েছেন। ১৯৭৪
ইংরেজী সালে বালুয়ার দীঘি
পাড়ের খানকাহ এ কাদেরিয়া
সৈয়্যেদিয়া তৈয়্যেবিয়া হতে আলহাজ নুর
মোহাম্মদ সওদাগর আল-কাদেরী
নেতৃত্বে সেদিন জুলুস চট্টগ্রাম
শহর প্রদক্ষিণ করে জামেয়া আহমদিয়া
সুন্নীয়া ময়দানে শেষ করে
জমায়েত হয়ে এক বিশাল
মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাহফিল
এর যে রূপ ধারণ
করেছিল, তা চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশে
এক নতুন ঈমানী চেতনা
সৃষ্টি করেছিল। বাংলাদেশসহ
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পরবর্তী পর্যায়ে
বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে
জশনে জুলুস ঈদে মিলাদুন্নবী
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উদযাপিত
হয়ে আসছে। আর
জশনে জুলুস নামক আলোড়ন
সৃষ্টিকারী ধর্মীয় শোভাযাত্রার প্রবর্তন
করেন- রহনুমায়ে শরীয়ত ও তরীকত,
গাউছে যামান, মুর্শিদে বরহক,
আওলাদে রাসূল আল্লামা হাফেজ
কারী সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যেব
শাহ রহমাতুল্লাহি আলাইহি ।
পরিশেষে
আমরা বুঝলাম, ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম উদযাপনের সাথে জড়িত আছে
মুসলিমদের ইতিহাস এবং ঐতিহ্য। প্রতিবছর ঈদে
মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উদযাপনের
মাধ্যমে মুসলিম জাতি প্রিয়
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর
শিক্ষা ও জীবন ব্যবস্থাকে
নিজেদের কর্মজীবনে বাস্তবায়নের মাধ্যমে নিজেদের জীবনকে সুন্দর করে
গড়ে তোলার উদ্দেশ্য নতুন
করে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়। আর
এ দিন বিশ্ব মুসলিমের
জন্য নতুন করে আত্মিক
পরিশুদ্ধির দিন। এ
দিনে আমরা এ শপথ
নেব যে- নামাজ পরিত্যাগ
করব না এবং হালাল
হারাম মেনে চলব।
সর্বপরি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম’র আদর্শে নিজেদের
জীবন গড়বো।
আ’লা হযরত ইমাম
আহমদ রেযা খান ফাযেলে
বেরেলভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন-
“যিকরে
মিলাদুন্নবী করতা রাহোঙ্গা উমর
ভর,
জ্বলতা
রাহো নজদীও জলনা তোমহারা
কাম হ্যায়”।
অর্থ:
জীবন ব্যাপী করব মোরা
নবীজীর মিলাদ স্মরণ,
জ্বলতে
থাক নজদী ওহে জ্বলেই
হবে তোদের মরণ।
আল্লামা
ড. মুহাম্মদ ইকবাল রহমাতুল্লাহি আলাইহি
এর ভাষায়-
“ব- মুস্তফা, ব-রসা খেশ
রা কে হাঁসা দ্বীন
উস্ত
আগর বা উ না
রাশিদি তামাম বু- লাহাবী
আন্ত”।
অর্থাৎ
“তুমি মোস্তফার চরণে নিজেকে সম্পূর্নভাবে
বিলীন করে দাও।
যদি তা না পার,
তবে তুমি আর আবু
লাহাবের মধ্যে কোন পার্থক্য
নাই”।
সর্বোপরি
রাসূল প্রেমে অবগাহন করে
সাচ্চা মু’মিন মুসলমানে
পরিণত হওয়ার দীপ্ত শপথ
নিয়ে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র কাজে নিজেকে
সমর্পন করার মাধ্যমে আল্লাহর
সন্তুষ্টি অর্জন করি।
আমিন বিহুরমাতি সায়্যিদিল মুরসালিন।
তথ্যসূত্রঃ
১. আল-কুরআনুল কারীম।
২. ইবনু মানযুর: লিসানুল
আরাব; বৈরুত, প্রথম সংস্করন।
৩. মুফতী আমীমুুল ইহসান:
কাওয়ায়িদুল ফিকহ; আশরাফিয়া বুক
ডিপো, ভারত, প্রথম সংস্করণ-১৩৮১ হি:।
৪. আবু দাউদ সুলাইমান
ইবনু আশ-আছ সিজিসতানী:
আস-সুনান শরীফ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন