বুধবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৫

eid -e- milad-un nabi | দেশে দেশে মিলাদুন্নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)

মুফতি মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল আলী কাদেরী

কামিল (হাদিস, ফিক্হ) বি.এ (অর্নাস)


পবিত্র মাহে রবিউল আউয়ালে শুধু আমাদের দেশে নয় দুনিয়ার দেশে দেশে মিলাদুন্নবী অনুষ্ঠান যুগ যুগ ধরে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। ইতিহাস ও সিরাতগ্রন্থ বিশেষত মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর পূর্ববর্তী বরেণ্য বুযুর্গদের লিখিত কিতাবাদী তার জ্বলন্ত প্রমাণ। যেমন আল্লামা মুসাল্লাম আলী ক্বারী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি তার উস্তাদ হাফীযুল হাদীস ইমান শামসুদ্দীন সাখাভী (১৪২৮-১৪৯৭ খৃ./৮৩১-৯০২ হিজরী) রাহমাতুল্লাহি আলাইহি এর উক্তি এভাবে উল্লেখ করেন- মুসলিম জাহানের দিকে দিকে বড় বড় শহরে নগরে বড় বড় শহরে নগরে ব্যাপকভাবে হুযূরে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাসাল্লামমের জন্ম মাসে মুসলমানগণ অপূর্ব ধরণের খাবার পরিবেশনসহ মিলাদ অনুষ্ঠান করে আসছেন। এই রাতে (মিলাদের রাতে) নানাবিধ সাদকা খয়রাত করেন। আনন্দ ও উল্লাস প্রকাশ এবং অন্যন্ত গুরুত্ব ও মনোযোগের সহিত মিলাদ শরীফ পাঠ করেন। মাওরিদুর রাবী ফি মাওলিদিনন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ১২৮ পৃষ্ঠা। বুখারী শরীফের ব্যাখ্যাকার ইমাম কুস্তালানী (১৪৪৮-১৫১৭ খৃ./৮১৫-৯২৩ হিজরী) রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ও শায়খ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (১৫৫১-১৬৪২ খৃ//৯৫৮-১০৫২ হিজরী) (রাঃ) এ বিষয়ে প্রায় অনুরূপ লিখেছেন।
মুফতি এনায়ত আহমদ কারওরী (৮১৩ খৃ./ ২২৮হিজরী) লিখেনমুক্কা ও মদীনা শরীফ এবং অধিকাংশ ইসলামী শহরে প্রচলন হলো রবিউল আউয়াল মাসে মিলাদ শরীফের অনুষ্ঠান করা। মুসলমানদেরকে জমায়েত করে হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্মের আলোচনা ও দুরূদ শরীফ বেশি বেশি করে পড়া, দাওয়াতীখানা অথবা শিরণী বিতরণ করা।
প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ইমাম শামসুদ্দীন সাখাভী (রাঃ) (১৪২৮-১৪৯৭ খৃঃ/৮৩১-৯০২ হিজরী) বলেন-মক্কা মোকাররামায় কয়েক বছর ধরে মীলাদ শরীফের অনুষ্ঠানে শরীক হওয়র এবং তার বরকত অনুধাবন করার সৌভাগ্য যারা অর্জন করেছিলেন, আমিও তাদের একজন। হাফিজুল হাদীস ইমাম আবুল ফয়েজ আব্দুর রহমান ইবনুল জাওযী (১১১৬-১২০১ খৃঃ/ ৫১০-৫৭৯ হিজরী)
হারামাইন শরীফ, মিশর, ইয়ামন, সিরিয়া এবং থেকে পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত আরবের সকল শহর নগরের অধিবাসীদের মধ্যে অব্যাহতভাবে এ নিয়ম চলে আসছে যে, তারা হুযূরে পাকের মিলাদ অনুষ্ঠান করেন। রবিউল আউয়ালের নতুন চাঁদের আগমনে উল্লসিত হন, গোসল করেন, দামী পোশাক পরিধান করেন, নানা প্রকার সাজ-সজ্জা করেন, সুগন্ধি ব্যবহার করেন, সুরমা লাগান রবিউল আউয়ালের এই দিনগুলোতে আনন্দ উৎসব করেন, হাতের সম্পদ টাকা পয়সা মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দেন এবং অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে মিলাদ শরীফ পাঠ ও শ্রবণের ব্যবস্থা করে অধিক সওয়াব এবং বিরাট সাফল্য অর্জন করেন (আদ্দুররুল মুনাজ্জাম ১৩৬ পৃষ্ঠা)
নিুে আমি এর দু’একটি উদাহরণ পেশ করছি, যা বিষয়টি অনুধাবনে সহায়তা করবে
মক্কা ও মদীনা শরীফে মিলাদুন্নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ঃ
মিলাদুন্নবী সম্পর্কে ভিন্নমত পোষণকারী বর্তমান সৌদি সরকার ও তার মদদপুষ্ট আলিমদের প্রভাবে যদিও আজকাল মক্কা ও মদিনা তথা হারামাইন শরীফাইনে মিলাদুন্নবী অনুষ্ঠিত হয় না বা এরকম অনুষ্ঠানে বাধা দেয়া হয় কিন্তু আগেরকার যুগে প্রতি বছর হারামাইন শরীফাইনে অতি আড়ম্বর ও উৎসাহ উদ্দীপনায় মীলাদুন্নবী অনুষ্ঠিত হত।
শাহ ওলিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (১৭৬২ খৃঃ) রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন- “ফয়জুল হারামাঈন” পৃষ্ঠা ৮০ কিতাবে বলেন,
وكنت قبل ذلك بمكة المعظمة فى مولد النبى صلى الله عليه وسلم فى يوم ولادته والناس يصلون على النبى صلى الله عليه وسلم ويذكرون ارهاصاته التى ظهرت فى وقت ولادته ومشاهده قبل بعثته فرأيت انوارا-
আমি একবার হুযূরে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাসাল্লাময়েম জন্মের তারিখে মক্কা মোয়াজ্জামার সেই ঘরে উপস্থিত ছিলাম যেখানে হুযূরের শুভ জন্ম হয়েছিল। লোকজন হুযূরের উপর দরূদ পাঠ করছিলেন, হুযূরে পাকের জন্ম সময়কার এবং নবুওয়াত প্রকাশের পূর্বেকার আশ্চর্য ও অলৌকিক ঘটনাবলী বর্ণনা করছিলেন। এমনি সময় হঠাৎ দেখতে পেলাম নূর চমকাচ্ছে। আমি বলিনা যে, তা আমার শরীরে চক্ষু দিয়ে দেখেছি আর এও বলব যে, রূহের চক্ষু দিয়ে দেখেছি। আল্লাহ ই জানেন, এ দু’য়ের মাঝা-মাঝি কেমন একটা অবস্থা ছিল। আমি এ নূর গুলোর মধ্যে ধ্যান করতে বুঝতে পারলাম ইহা সে সমস্ত ফিরিশতার নূর যারা এ ধরনের মজলিসে উপস্থিত হয়ে থাকেন- (ফুইউজুল হারামাইন-৮০পৃষ্ঠা)।
হযরত আব্দুল গণি মুহাদ্দিসে দেহলভী রাহমাতুসাল্লামহ আলাইহি-এর পবিত্র মদিনা মুনাওয়ারায় মিলাদ শরীফে শরীক হওয়ার বর্ণনা তাঁর বিশিষ্ট শাগরিদ শাহ আব্দুল হক এলাহাবাদী এভাবে বর্ণনা করেন- সিফায়ে সায়েল গ্রন্থে শাহ আব্দুল গণি দেহলভী সাহেব লেখেছে –
وحق انست كہ نفسى ذكر ولادت انحصرت صلى الله عليہ وسلم وسرور و فاتحة نمودن يعنى ايصال ثوب فتوح سيد الثقلين ازكمال سعادت انسان است-
অর্থ : সত্য কথা হল, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘র মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পালন করা ফাতিহা পড়ে তাঁর মহান রুহে সওয়াব রেসানী এবং তাঁর মিলাদ শরীফে আনন্দ করার মধ্যেই রয়েছে মানুষের পূর্ণাঙ্গ সৌভাগ্য। (সেফায়ে সায়েল)
উমদাতুল মুফাস্সিরীন জুবদাতুল মুহাদ্দিসীন জনাব মাওলানা শাহ আব্দুল গণি ছাহেব নকশবন্দী মুজাদ্দিদীকে আমি দেখেছি মদিনায় রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখে রবিবার দিনে মসজিদে নববীতে মিলাদ শরীফের অনুষ্ঠানে তিনি শরীক হন এবং মসজিদে নববীর আঙ্গিনায় মিম্বরে বসে একের পর এক ইমামগণ রওজা শরীফের দিকে মুখ করে হুযূরে পাকের জন্মের যে আলোচনা করছিলেন তা শুনেন। কিয়ামের সময় সবার সাথে কিয়ামও করেন। এ পবিত্র মাহফিলে হাল ও বরকত যা প্রকাশ পেয়েছিল, তা বলার ভাষা নেই। (আদ্দুররুল মুনাজ্জাম-১৩৮ পৃষ্ঠা)তবে, আজকালও মক্কা-মদিনা তথা সৌদি আরবের কতিপয় বিশিষ্ট উলামাই কিরাম ও বুর্যুগানে দ্বীনের ঘরে মিলাদুন্নবীর অনুষ্ঠান অতি উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে উদযাপন করা হয়। এই সমস্ত মাহফিলে অনেক লোক অংশগ্রহণ করে থাকেন। বিশেষত হজ্জের মৌসুমে অনুষ্ঠিতমাহফিলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অসংখ্য মানুষ অংশগ্রহণ করে থাকেন।
মিশর ও সিরিয়ায় মিলাদুন্নবী ঃ
মিশর ও সিরিয়ায় মিলাদুন্নবী উদযাপনের বর্ণনায় মুসাল্লাম আলী ক্বারী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন মিশর ও সিরিয়ায় ৭৮৫ বছর আগ থেকে মুসলমান বাদশাহরা পালল করে আসছিল ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসছিল।অতএব, ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উদযাপনের সাথে জড়িত আছে মুসলিম ইতিহাস ঐতিহ্য। প্রতি বছর ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উদযাপনের মাধ্যমে মুসলিম জাতি প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শিক্ষা ও জীবন ব্যবস্থাকে নিজেদের কর্মজীবনে বাস্তবায়নের মাধ্যমে সুন্দর করে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে নতুন করে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়। এ দিন বিশ্ব মুসলিমের জন্য নতুন করে আতিœক পরিশুদ্ধির দিন। শীষাঢালা প্রাচীরের মতো মুসলিম উম্মাহার সংহতি দৃঢ় করার দিন। এ দিনে আমরা এ শপথ নেব যে, নামাজ পরিত্যাগ করবো না, হালাল-হারাম মেনে চলবো, সর্বোপরি নবীজির আদর্শে নিজেদের গড়বো। আসুন, রাসূল প্রেমে অবগাহন করে সাচ্ছা মু’মিন মুসলমানে পরিণত হয়ে দীপ্ত শপথ নিয়ে রাসূলের কাছে নিজেকে সমর্পণ করার মাধ্যমে আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টি অর্জন করি। আমিন! বিহুরমাতি সায়্যিদিল মুরসালিন।
“ব-মুস্তফা ব-রসা খেশ রা কে হামাঁ দ্বীন উস্তআগর বা উ না রসিদি তামাম বু-লাহাবী আস্ত”অর্থঃ তুমি মোস্তফার চরনে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে বিলীন করে দাও। যদি তা না পার তবে তুমি আর আবু লাহাবের মধ্যে কোন পার্থক্য নাই।
মুফতি মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল আলী কাদেরী
কামিল (হাদিস, ফিক্হ) বি.এ (অর্নাস)
সহ -সুপার, কাদেরিয়া তৈয়্যেবিয়া কামিল মাদরাসা (মহিলা শাখা)
মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন