মঙ্গলবার, ১ মার্চ, ২০১৬

ইমাম আহমদ রেজার বদান্যতা ও আমাদের করণীয়



ইমাম আহমদ রেজার বদান্যতা আমাদের করণীয়
মুহাম্মদ মুহিব্বুল্লাহ সিদ্দিকী

সমগ্র বিশ্ব যাকে লা হযরত বলে চিনেন, তাঁর মূল নাম হচ্ছেআহমাদ রেজা খান তিনি ভারতের ইউ.পি প্রদেশের বিখ্যাত বেরেলীর জসূলী নামক মহল্লায় ১০ শাওয়াল ১২৭২ হিজরি মোতাবেক ১৪ জুন ১৮৫৬ খ্রি. শনিবার পৃথিবীতে শুভাগামন করেন তাঁর পিতা তৎকালীন সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেম মাওলানা শাহ্ হাকীম নকী আলী খান, আর মাতার: হুসাঈনী খানম রাহমাতুল্লাহি আলাইহিমালা হযরত একজন বড় মাপের জ্ঞানী ছিলেন মজার বিষয় হল তার মাত্র ৬জন শিক্ষক ছিলেন তিনি ৪বছর বয়সে পবিত্র কুরআন শিখেছিলেন তারপর প্রাথমিক শিক্ষা নাহু, সরফ, উর্দু, ফারসীর জ্ঞান অর্জন করেন, তাঁর পিতার ঘনিষ্ঠ বন্ধু মাওলানা গোলাম কাদের বেগ সাহেবের নিকট তারপরশরহে ছমগীনীনামক কিতাব পড়েন মাওলানা আব্দুল আলী রামপুরী সাহেবের নিকট কোরআন, হাদিস, তাফসির, ফিকহ, বালাগাত, মানতিক, উসুল, দর্শন, তাসাউফসহ বিভিন্ন বিষয়ের জ্ঞান অর্জন করেন, আপন পিতা যুগ শ্রেষ্ঠ আলেম মাওলানা শাহ্ হাকীম নকী আলী খান সাহেবের কাছ থেকে লা হযরত যখন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন, তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ১৩ বছর ১০ মাস দিনহাজারের অধিক গ্রন্থ রচনাকারী এই মনিষী ২৫ সফর ১৩৪০ হিজরি মোতাবেক ২৮ অক্টোবর ১৯২১ খ্রি. জুমারদিন দুপুর টা ৩৮ মিনিটে, যখন মসজিদে জুমার আযান হচ্ছিল, ঠিক তখনই জগতের লক্ষ-কোটি ভক্তকে শোকের ধরিয়াতে ভাসিয়ে ধরাধাম ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)
অভিশপ্ত মুহাম্মদ বিন আবদুল ওহহাব নজদী (১৭০৩-১৭৯২খ্রি.) যখন সৌদি আরবের তৎকালীন বাদশার যোগসাজশে ইসলামের সভ্যতা-সংস্কৃতিকে শেকড়সহ কবর দিতে লাগল এবং আস্তে আস্তে এর প্রভাবে ইসলামের সমূহ ক্ষতি সাধন শুরু হল অন্যদিকে ১৮৬৬ সালে সঠিক মতাদর্শ প্রচার করার লক্ষ্যে হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন হাসান চিশতী রাহমাতুল্লাহি আলাইহিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয় ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ মাদরাসা, কাসেম নানুতুবী রশিদ আহমদ গাঙ্গোহী যার মূল হোতা পথভ্রান্ত ওহহাবী দেওবন্দীদের নখর থাবা থেকে আমাদেরকে সঠিক ঈমান-আকিদা-ইসলামের পরিচয় করিয়ে দিয়েছন যিনি, তিনি হলেন চতুর্দশ শতাব্দীরসমাজ সংস্কারকলা হযরত ইমাম আহমদ রেজা খাঁন বেরেলী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি (১৮৫৬-১৯২১খ্রি.)
লা হযরত; এটি একটি প্রতিষ্ঠানের নাম একটি মানুষ যখন একাধিক কাজের কাজী হয়ে যান জাতি তাকে হরেক রকম কাজের মানুষ হিসাবে জানে, তখন তিনি আর একটি ব্যক্তির ফ্রেমে আবদ্ধ থাকেন না, তখন আবদুর রহমান সাহেব হয়ে যানরহমান গ্রুফ অব কোম্পানীতথা তিনি তখন একটি প্রতিষ্ঠান লা হযরত কি না ছিলেন? মা-বাবার কলিজার ধন, ছেলে-মেয়ের আদর্শ পিতা, একজন উচ্চমাপের জ্ঞানী, সমাজপতি, আলেম, লেখক, সু-বক্তা, মোনাজির, মুফতি, হাফেজ, শিক্ষক, পীর, কবি, সাহিত্যিক, দানশীল, কর্মঠ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ, গণিতবিদ, তাসাউফবিদ, সমাজ সংস্কারক, হাজ্বী, গাজী, কাজীসহ অসংখ্য গুণবাচক শব্দ উনার শানে ব্যবহারের যুক্তিযুক্ত কারণ রয়েছে উনি কোন বিষয়ে লেখার বাকি রেখেছেন? পবিত্র কোরআনের তাফসীর, হাদিসের ব্যাখ্যা, ইলমে ফিকহ, ইলমুল কালাম, ইতিহাস, মানাকিব, সিয়ার ফালসাফাসহ ৫৫টি বিষয়ের উপর প্রায় সহস্রাধিক কিতাব লিখেছেন
মহান আল্লাহ তাআলা পবিত্র কালামে হাকিমে ঘোষণা করেন- “তোমরা আল্লাহর দেওয়া নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করো অন্যদিকে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- “যে ব্যক্তি মানুষের কাছে কৃতজ্ঞ নয়, সে আল্লাহর কাছেও কৃতজ্ঞ নয় আমরা দুনিয়াবী পরিবেশে দেখি একজন মানুষ যখন অন্যজনকে উপকার করে, উপকারপ্রাপ্ত ব্যক্তি উপকার দাতার কাছে কৃতজ্ঞ থাকেন আমরণ যোগাযোগ রক্ষা করেন কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায়, আইনজীবি যখন তার দক্ষতা যুক্তিতর্কের মাধ্যমে -প্রাপ্ত আসামীকে খালস করেন, পরবর্তীতে খালাস প্রাপ্ত ব্যক্তি আইনজীবিকে আপন সহোদর ভাই থেকে বেশি ভালোবাসেন, এমনকি প্রচলিত ধর্মের ভাই ভাই বা বোন বানিয়ে ফেলেন যিনি আমাদের অন্ধকার থেকে আলোর রাস্তা দেখালেন, যিনি ঈমান বিষয়ে অবুঝদের বুঝ দান করলেন, যিনি আকিদা বিষয়ে মূর্খদের জ্ঞানী বানালেন, যিনি মরা গাংতে নবীপ্রেমের ধাবাতে উজ্জীবিত করলেন, যিনি লিখনী আচরণের মাধ্যমে আল-কোরআনের সেই চিরন্তন পথসিরাতে মুস্তাকীমআমাদের দেখালেন তার প্রতি কি আমাদের কোনো দায়িত্ব নেই?
আজকের কাওমীরা প্রাণ পেয়েছে তাদের অন্যতম গুরু মৌং থানবীর লিখনী ধর্মীয় জ্ঞান সম্পদের মাধ্যমে মৌং থানবী মাত্র পাঁচশতের মত বই লিখে যদি এত্ত বাহাবা শ্লোগান পেতে পারে, লা হযরত কেন হাজারের বেশি লিখে পাবেন না? আজকে মওদুদীবাদীরা তাদের ঠাকুরের লিখিত বইগুলো বাজারে পুরোদমে ছাপাচ্ছে বাস্তবতা হচ্ছে বাজারেইসলামী বইনামে যে জগৎ রয়েছে তার ৯৫% বাতিলদের হাতের কব্জায় দখল!
আমরা ব্যর্থ কারণ আমরা লা হযরতকে ঘরে ঘরে পৌঁছাতে পারিনি আর কিছু না হোক লা হযরত যে একজনবড় মানের লেখককিংবাহাজার কিতাবের প্রণেতাইস্যুটি জাতির সামনে উপস্থাপন করত: তা প্রচার করে বিশ্বের ১৫০কোটি মুসলমানের হৃদ মাযারে লা হযরতের মনছবি আকঁতে পারতাম পাশাপাশি কাফির-বিধর্মীদের দৃষ্টি আকর্ষণও করতে পারতাম
কবি বলেন- “মেঘ দেখে কেউ করিস নে ভয়, আড়ালে তার সূর্য হাসে সূখের খবর লা হযরত নিয়ে বাংলাদেশে যে খুব কম কাজ হয়েছে তা নয়, জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া চট্টগ্রাম কাদেরিয়া তৈয়্যেবিয়া কামিল মাদরাসা ঢাকার মত দুটি প্রসিদ্ধ সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান লা হযরত নিয়ে কাজ করছে দিবা-রাত্রি ব্যাপি এছাড়া অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সংগঠন, সংস্থা রয়েছে, যেগুলো লা হযরত নিয়ে কাজ করার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে প্রায় শতাধিক লা হযরতের লিখিত কিতাব আমাদের মাতৃভাষায় অনূদিত হয়েছে আজকের গ্রামের মুয়াজ্জিন থেকে নগরের খতীব পর্যন্ত লা হযরতকে চেনেন আওর মুহাম্মদীয়া নামে তরীকত চর্চাকারীরাও লা হযরতের কিতাব অধ্যায়ন করছেন লা হযরত কর্তৃক লিখিত বিশ্ববিখ্যাত না শরীফসবসে আওলা ওয়া লা হামারা নবীসঙ্গীতটি আজ পল্লী থেকে শহর পর্যন্ত সকল নবীপ্রেমিক জ্ঞানপিপাসুদের নরম কন্ঠে সকালে সম ধব্বনিতে উচ্চারিত হয়
বর্তমান লা হযরত এর প্রচার-প্রসার সময়ের দাবি হয়ে পড়েছে কারণ কিছু জ্ঞানপাপী যখন প্রিয়নবীজীকে মানুষের কাতারে দাঁড়করানোর অপচেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, সাহাবায়ে কিরামের বিষয়ে বদআকিদাধারীরা ভিন্ন মন্তব্য করছে, মাযহাব-তাকলিদকে যখন সর্বোচ্চ গুনাহর মিথ্যা বয়ান ছড়ানো হচ্ছে অপর দিকে তরীকতের নামে যখন কিছু জ্ঞান আমল শূন্য - শীতল তরীকতকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে, মানুষ সুন্নতে নববী অনুসরণ ব্যতিরেখে ইচ্ছাধীন মনমত চলছে, দ্বীনের পথে না চলে নাস্তিক্যবাদকে গ্রহণ করছে লা হযরতের মধ্যে কি ছিল না? আকিদা-আমলে তিনি ছিলেন শতভাগ পাকা মোদ্দা কথা, লা হযরত হলো শরীয়ত-তরীকত, দ্বীন-ইসলাম, সুন্নাত, আমলের সমন্বয়ে একটি প্রতিষ্ঠানে, যেখানে প্রায় সব কিছু পাওয়া যায়
সময় এসেছে লা হযরত প্রচারে প্রত্যেককে অবদান রাখার আনজুমান- রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট কি একাই বাংলাদেশে মাসলাকে লা হযরত প্রচারের দায়িত্ব পালন করবে? “দশে মিলে করি কাজ হারি জিতি নাহি লাজসকলে সমন্বিত কর্মপন্থা গ্রহণ করলে লা হযরতের দর্শন বাস্তবায়ন সময়ের ব্যাপার মাত্র লা হযরত প্রেমিকদের নিকট কিছু প্রস্তাব পেশ করলাম, যা অনায়সে আমরা চাইলে করতে পারি, যেটা করলে পরে হয়তবা লা হযরত প্রচারের একটি বড় কাজ হবে যা হলো:
.            বিবাহ, অলিমা, সুন্নাতে খৎনাসহ ধর্মীয় সামাজিক অনুষ্ঠানে উপহার দেওয়ার ক্ষেত্রে টাকা, কোকারিজ, প্রাইজবন্ড ইত্যাদি না দিয়ে, লা হযরতের লিখিত বইসমূহ হতে উপহার দেয়া
.            বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি-বেসরকারি গণপাঠাগার, মসজিদ ভিত্তিক পাঠাগার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব লাইব্রেরিতে লা হযরতের লিখিত বই সমূহ রাখা
.           ধর্মীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সংস্থা, সমিতি লা হযরতের নামে নামকরণ করা
.            আকিদার আলোচনার সাথে লা হযরতের আমলী জীবন নিয়ে কথা বলা
.            লা হযরত সম্পর্কিত নানা বিষয়ের উপর সেমিনার, সভা, কনফারেন্সসহ সৃজনশীল প্রোগ্রামের আয়োজন করা
.           লা হযরতের পবিত্র কোরআনের ব্যাখ্যাগ্রন্থকানজুল ঈমানকে বিশেষ করে পাঠক মহলের কাছে পৌছানো
.            পাঠ্য পুস্তক, নোটবই, গাইডবইতে লা হযরতের বিভিন্ন বিষয়ের উপর মতামতগুলো উল্লেখ্য করা ডায়েরী, ক্যালেন্ডারে লা হযরতের উক্তিকে যুক্ত করা
.           বিশেষ করে লা হযরতের খোশরোজ বেছাল উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা
.            বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আলোচ্য বিষয়ে লা হযরতকে যুক্ত করা যেমন: কোনো মাহফিলে আলোচনার বিষয় দেয়া হলো: নবীপ্রেম লা হযরত, হানাফী মাযহাব প্রচারে লা হযরতের আবদান ইত্যাদি
১০.         লা হযরত সম্পকির্ত যাবতীয় অনুষ্ঠানের ছবি ভিডিও সংরক্ষণ করা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইজবুক, ইউটিউবসহ বিশেষ করে গণ মাধমে প্রচার-প্রসার নিশ্চিত করা
১১.         লা হযরতের প্রকাশিত অনূদিত বইগুলোকে নিয়ে অ্যাপস্ তৈরি করা
১২.          ত্রৈমাসিক/মাসিক ভিত্তিতে লা হযরতের লিখিত না শরীফের উপর চর্চা সুর প্রয়োগ প্রোগ্রাম করা
আসুন! দ্বীন, মাযহাব মিল্লাতের ক্রান্তিক্ষণে রাসূলেপাকের আদর্শের মূর্তপ্রতীক, সাহাবায়ে কেরাম আওলাদে রাসূলের অনন্য প্রেমিক, হোসাইনী ইসলামের অকুতভয় সৈনিক লা হযরত ইমাম শাহ্ আহমদ রেজা খাঁন বেরেলী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি এর পথ মতে নিজে চলি পাশাপাশি পরিবার, সমাজ, বন্ধুমহল, আত্মীয় স্বজন, পাড়া-পড়শীদের চলার পরামর্শ প্রদান করি

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন