মঙ্গলবার, ১ মার্চ, ২০১৬

কবি নজরুলের লিখনিতে নবী প্রেমের উন্মেষ - একটি বিশ্লেষণ

কবি নজরুলের লিখনিতে নবী প্রেমের উন্মেষ ঃ একটি বিশ্লেষণ
মাও. আ.ম.ম. মাছুম বাকী বিল্লাহ

আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাঙ্গালী জাতির ও বাংলা সাহিত্যের এক মহা সম্পদ। নজরুলের জন্ম বাঙালী মুসলিম সমাজে। সব মহৎ শিল্পী-সাহিত্যিকদের মত তিনি স্ব-জাতি মুসলমানদের জন্য তাঁর জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভেবেছেন। বিশেষ করে বাঙালী মুসলিম সমাজের জন্য তাঁর কলম ছিল ক্ষুরধার। আর এ জন্যই তিনি নিজের বিণীত পরিচয়ে “খাদেমুল ইসলাম নজরুল ইসলাম” লিখতেও এতটুকুন কুণ্ঠাবোধ করেননি। তিনি তাঁর লিখনীতে মুসলমানদের নবী বিশ্ব মানবতার মুক্তিদূত, স্বাধীনতার মুক্তির সনদ ও করুণার মূর্ত প্রতীক হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা আহমদ মোজতবা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতি যে বর্ণনাতীত  ভালোবাসা, প্রেম ও শ্রদ্ধা দেখিয়েছেন তা হয়ত আর কোন বাঙালী সাহিত্যিক দেখিয়ে যাননি। কি তাঁর গান, কি কবিতা সব জায়গায় তিনি রাসূল প্রেমের এক দ্যূতি ছড়িয়েছেন। যা আজো কোটি মুসলমানদের মুখের কথা, প্রাণের কথা। আমার গবেষণায় আমি তাঁকে রাসূল প্রেমে এমন এক মহান সাধক ও চিরবিভোর অবস্থা পেয়েছি যেন তিনি তাঁর সবকিছু নবী প্রেমে সপে দিয়েছেন আর নিজেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর একজন বাধ্য শিষ্য রুপে আত্মপ্রকাশ করাতে ব্যাকুল হয়ে উঠেছেন।
কবিতায় দরুদ ঃ
কবি নজরুল লিখেন-
উরজ্ য়্যামেন্ নজ্দ হেজাজ্ তাহামা ইরাক শাম
মেসের ওমান্ তিহারান-স্মরি’ কাহার বিরাট নাম,
পড়ে- “সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম” 
কবি এখানে ইয়ামেন, নজদ, হিজাজ, ইরাক, ইরান, মিসর, ওমান ও তেহরান সহ বিশ্বব্যাপী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নাম মোবারক নিয়ে মানুষ কিরুপ শ্রদ্ধা ও পূর্ণভক্তি সহকারে উনার প্রতি দরুদ পড়েন তার উল্লেখ করেন।
কবি আরো বলেন- “আমার সালাম পৌছে দিও নবীজীর রওজায়” 
সৃষ্টির প্রাণ ঃ
নজরুল তাঁর কবিতায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে সৃষ্টিজগতের দম বা প্রাণ বলে সম্বোধন করেছেন। তাঁর ইনতিকালের পর মক্কা ও মদিনার অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন-
মক্কা ও মদিনায় আজ শোকের অবধি নাই।
যেন রোজ-হাশরের ময়দান, সব উন্মাদ সম ছুটে !
কাঁপে ঘন ঘন কাবা, গেল গেল বুঝি সৃষ্টির দম টুটে !
আর মিরাজের রজনীতে সৃষ্টিজগতের সেই প্রাণ আল্লাহর কাছে সৃষ্টি জগতের উর্ধ্বে লা মাকামে  যাওয়ার কারণেই পৃথিবীর সবকিছু ছিল অচল। তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফিরে এসে দেখেন, তাঁর যাওয়ার পূর্ব মুহুর্তে সম্পন্ন করা অযুর পানি এখনো গড়িয়ে যাচ্ছে, বিছানাটা এখনো উষ্ণ। অথচ ঘুরে এসেছেন অগণিত মাইলের দূরপথ।
আয়াতের অনুবাদ ঃ   
আমপারার দুটি আয়াতে আল্লাহ পাক বিশেষভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ব্যাপারে ইরশাদ করেছেন। আর নজরুল তার কাব্যিক অনুবাদ করেছেন এইভাবে-
আয়াত-“(হে নবী) আমি আপনার আলোচনাকে সমুচ্চ করেছি”  (অনুবাদ- “করিনি কি মহীয়ান মহিমা-বিথার?”  আয়াত-“(হে নবী) আপনার পালনকর্তা অতিসত্বর আপনাকে এমন দান করবেন, অতপর আপনি তাতে সন্তুষ্ট হবেন।’   অনুবাদ- “অচিরাৎ তব প্রভু দানিবেন, (সম্পদ) খুশী হইবে যাতে।” 
বায়রনের যেমন গ্রীসের প্রতি হৃদয়ের একটা টান ছিল নজরুলের ছিল তেমনি “জাজিরাতুল আরব” এর প্রতি। এই আকর্ষণের কারণ যে ইসলাম ধর্মের প্রচারক হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্মভুমি তাতে সন্দেহ নেই। সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতি নজরুলের সীমাহীন অনুরাগ প্রদর্শন। ‘খেয়াপারের তরণী’ কবিতায় নজরুল এই মহামানবের প্রতি তাঁর অনুরাগ প্রথম প্রদর্শন করেন। এ কবিতায় তিনি বললেন হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুদক্ষতম কান্ডারী, সুতরাং যাঁরা ইসলাম-তরণীর আরোহী, তাদের শত ঝড়-ঝঞ্ঝায় কোন বিপদের আশঙ্কা নেই। সমস্যা-সঙ্কুল এই পৃথিবীর তমসাকীর্ণ সময় ততক্ষণ নির্ভয়ে পাড়ি দিতে পারবে যতক্ষণ তারা হযরতের নির্দেশিত পথে চলবে।
মরুভাস্কর কাব্যগ্রন্থ ঃ
১৯৩০ খ্রীস্টাব্দের দিকে নজরুল যখন ইসলামী গান লিখতে শুরু করেন, তখন হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপর প্রশস্তিমূলক নাত (হযরত মুহাম্মদ দ. এর শানে রচিত কবিতা বা পদ) রচনার সময় বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে নিয়ে নজরুল একটি কাব্যগ্রন্থ রচনায় আত্মনিয়োগ করেন। দুর্ভাগ্যের বিষয় নজরুল এই কাব্যটি সম্পূর্ণ করে যেতে পারেন নি। নবীর জীবনী বর্ণনামূলক এই দীর্ঘ প্রবন্ধ কাব্যের ১৭টি পরিচ্ছেদ কবি সম্পন্ন করেন, কিন্তু ১৮তম পরিচ্ছেদটি তিনি সম্পূর্ণ করতে পারেন নি। “সাম্যবাদী” নামে এই পরিচ্ছেদের মাত্র ষোলটি পংক্তি রচিত হয়েছিল। নজরুলের আকস্মিক রোগাক্রান্ত এবং নিশ্চল হওয়ার দরুণ “মরু-ভাস্কর” অসমাপ্ত থেকে যায়। মরুভাস্কর গ্রন্থের ভুমিকায় কাজী নজরুল ইসলামের স্ত্রী প্রমীলা বলেন ঃ
“বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (দ.) এর জীবনী নিয়ে একখানী বৃহৎ কাব্যগ্রন্থ রচনার  কথা তিনি প্রায়ই বলতেন।”
কবি এ কাব্যগ্রন্থে নবীজী (দ.)’র বাল্যকালের প্রায় পুরো সময়টাকেই সুচারুরুপে এক কাব্যিক অলংকার দিয়ে বর্ণনা করেছেন। বিশ্বনবী (দ.) কে শিশু অবস্থায় যখন মা ‘আমিনা’ বাবা আব্দুল্লাহর কবর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে যান। ফিরে আসার সময় পথিমধ্যে মা ‘আমিনার’ ইন্তিকালের হৃদয় বিদারক কাহিনী তুলে ধরেন এভাবে-
“কিছু দূর আসি’ পথ-মঞ্জিলে আমিনা কয়-
বুকে বড় ব্যথা, আহমদ, বুঝি হ’ল সময়
তোরে একলাটি ফেলিয়া যাবার! চাঁদ আমার,
কাদিসনে তুই, রহিল যে রহমত খোদার!” 
আমরা দেখি যে, কবি নজরুল রাসূল (দ.) এর শিশুবেলার দুঃখে দুঃখিত ও ব্যথিত হয়েছেন এবং কবি তার বিভিন্ন কবিতায় এই বিষয়টি তুলে ধরেছেন। কবির হৃদয়ে ছিল শিশু এতিম নবীর প্রতি এক অকৃত্তিম আবেগ আর ভালোবাসা। কবি উক্ত কবিতায় লিখেন-
“সব শোকে দিবে শান্তি যে- শৈশব তাহার
কেন এত শোক-দুঃখময়?”
অর্থাৎ যিনি এসেছেন পুরো বিশ্বজাহানের সকলের দুঃখ ঘুচাবার তরে আর তিনিই কিনা এত দুঃখ, ব্যাথা নিয়ে শৈশব পার করেছেন। এ সৃষ্টিকর্তার এক অপার মহিমার লীলাখেলা, যেন এক প্রেম খেলা। বন্ধুর সাথে বন্ধুর, হাবিবের সাথে মাহবুবের, প্রেমাস্পদের সাথে প্রেমিকের। যা বুঝবার ক্ষমতা হয়তো কেবল চক্ষুস্মান প্রিয় প্রেমিক বান্দারাই রাখেন।
আরব সূর্য ঃ
কাজী নজরুল দয়াল নবীজী (দ.) কে আরবের উদিত সূর্য বলে উল্লেখ করে তাঁর গুণগান গেয়েছেন। সূর্য যেমনি করে সমস্ত জগতকে আলো দেয় তেমনি রাসূল (দ.) সমস্ত সৃষ্টি জগতের জন্য মহান সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে কল্যাণ ও রহমতের এক ঐশী আলো নিয়ে এসেছেন। কবির রচনায় এসেছে ঃ
জেগে ওঠ তুই রে ভোরের পাখী, নিশি প্রভাতের কবি !
লোহিত সাগরে সিনান করিয়া উদিল আরব-রবি।
তিনি আরো বলেন ঃ
নহে আরবের, নহে এশিয়ার, বিশ্বে সে একদিন,
ধূলির ধরার জ্যোতিতে হ’ল গো বেহেশত জ্যোতিহীন ! 
কবি তাঁর অন্য কাব্যগ্রন্থে লিখেন ঃ
“উঠেছিল রবি আমাদের নবী, সে মহা-সৌরলোকে,
উমর, একাকী তুমি পেয়েছিলে সে আলো তোমার চোখে!” 
দয়াল নবীর আগমনী সংবাদ ঃ
আরবী ভাষায় একটি প্রবাদ আছে যে, “মান আহাব্বা সায়আন আকছারা জিকরুহু” অর্থাৎ যে ব্যক্তি কোন কিছু ভালবাসে সে সব সময় শুধু ঐ বিষয় নিয়েই কথা বলে। আমরা দেখতে পাই যে কবি নজরুল তাঁর অসংখ্য লিখনীতে দয়াল নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নিয়ে বিভিন্নভাবে প্রশংসায় মেতে উঠেছেন। তাঁর আগমনের কথা বলেছেন, কখনো আবার এতিম বালক নবীজীর করূণ কাহিনী বর্ণনা করেছেন, আবার কখনো তাঁর অনুপম চরিত্রের জয়গান গেয়েছেন। কবি যেন নবীজীর আগমনে সারা দুনিয়ায় খুশির পয়গাম ছড়িয়ে দিচ্ছেন। কবির ভাষায়-
১.    “ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ এলো রে দুনিয়ায়
আয়রে সাগর আকাশ বাতাস দেখবি যদি আয়।
২.    “আসিছেন হাবিব-এ খোদা আরশ্-পাকে তাই উঠেছে শোর।”
৩.    “তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে
এধু পূর্ণিমারি সেথা চাঁদ দোলে
যেন ঊষার কোলে রাঙা-রবি দোলে।
‘মুহাম্মদ’ মোবারক নামের প্রশংসা ঃ
কবি নজরুল বিশ্বনবী (দ.) এর নামকরণের ইতিহাসও মরু-ভাস্কর কবিতায় তুলে ধরেছেন। রাসূল পাক (দ.) এর নাম রেখেছেন তাঁর দাদা তৎকালীন মক্কার কুরাইশ দলপতি আব্দুল মুত্তালিব। তিনি তা এভাবে বর্ণনা করেন যে-
“কহিল মুত্তালিব বুকে চাপি’ নিখিলের সম্পদ-
‘নয়নাভিরাম! এ শিশুর নাম রাখিনু ‘মোহাম্মদ’।” 
নজরুল তাঁর কবিতায় রাসূল (দ.) এর নাম মুবারকের প্রশংসায় মেতে উঠেছেন। এ যেন এক সত্য প্রেমিক, যে প্রমিক তার প্রেমাস্পদের সবকিছু নিয়েই বলতে চাই। প্রেমাস্পদের সবকিছুই নিয়েই যেন তার বলতে হবে, নতুবা প্রেমিক মনের পরিপূর্ণ তৃপ্তি হয় না। কবি বলেন ঃ
গুঞ্জরি ওঠে বিশ্ব-মধুপ- “আসিল মোহাম্মদ!”
অভিনব নাম শুনিল রে- ধরা সেদিন- “মোহাম্মদ!”
এতদিন পরে এল ধরার- “প্রশংসিত ও প্রেমাস্পদ!” 
কবি যেন এই ‘মুহাম্মদ’ নামটির প্রেমি পড়ে গেছেন। এখন শুধু এই নামটি জপাই কবি হৃদয়ের প্রশান্তি। তিনি বলেন-
“নাম মোহম্মদ বোল রে মন নাম আহমদ বোল
যে নাম নিয়ে চাঁদ-সেতারা আসমানে খায় দোল।”
(নজরুল-সঙ্গীত সংগ্রহ, সম্পাদনা- রশিদুন নবী, প্রকাশনা- নজরুল ইন্সটিটিউট, পৃষ্ঠা-১৭১)
“মোহাম্মদ নাম যত জপি, তত মধুর লাগে
নামে এত মধু থাকে, কে জানিত আগে।”
(নজরুল-সঙ্গীত সংগ্রহ, রশিদুন নবী কর্তৃক সম্পাদিত, নজরুল ইন্সটিটিউট, ২০১৪ খ্রি., পৃষ্ঠা-১৭৩)
কবি তাঁর “অনাগত” কবিতায় আরো বলেন ঃ
“মোহাম্মদ এ, সুন্দর এ, নিখিল- প্রশংসিত,
ইহার কন্ঠে আমার বাণী ও আদেশ হইবে গীত।” 
বিশ্বনবী মুহাম্মদ (দ.) এর আগমনে ধন্য হয়েছিল মক্কা, মদিনা, আরব, এশিয়া তথা সমগ্র বিশ্ব। কেননা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কুরআন মাজীদে ইরশাদ ফরমান-
“নিশ্চয়ই আমি আপনাকে সমগ্র বিশ্বজগতের জন্য রহমত সরুপ প্রেরণ করেছি”  কবি বলেন ঃ
“ধন্য মক্কা, ধন্য আরব, ধন্য এশিয়া পুণ্য দেশ,
তোমাতে আসিল প্রথম নবী গো, তোমাতে আসিল নবীর শেষ।” 
নবীজী (দ.) কে আল্লাহ পাক দুনিয়ার বুকে পাঠিয়েছেন সকল প্রকার ভেদাভেদ, হানাহানি-মারামারি ভুলিয়ে মানুষের মাঝে প্রেম-প্রীতি আর ভালোবাসা কায়েম করার জন্য। তিনি এই ধরায় এসে আইয়্যামে জাহেলিয়াতের এক বর্বর যুগের মানুষদের তৈরি করলেন পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে সোনার মানুষ। কবি তাই সেই তরুণ নবীর জয়গান গেয়ে বলেন-
“দেখিতে দেখিতে তরুণ নবীর সাধনা-সেবায়
শত্রু মিত্র সকলে গলিল অজানা মায়ায়।” 
“মোহাম্মদের প্রভাবে সকলে হইল রাজী,
সত্যের নামে চলিবে না আর ফেরেব-বাজী !”
মক্কার অধিবাসীরা মহনবী (দ.) কে অসম্ভব রকমের সত্যবাদী বালক হিসেবে জানতো। তারা মনে করতো মুহাম্মদের নিকট যা রাখা হবে তাই আমানত এবং নিরাপদ। সে কখনো মিথ্যা বলেনা। তাই তারা উনার নাম দিয়েছিল “আল-আমিন” অর্থাৎ বিশ্বাসী। কবি নজরুলও এ বিষয়টি এড়িয়ে যাননি। তিনি বলেন-
“ক্রমে ক্রমে সব কোরেশ জানিল- মোহাম্মদ আমীন
করে না কো পূজা কা’বার ভূতেরে ভাবিয়া তাদেরে হীন।” 
আল্লাহর সাথে নবীজীর উল্লেখ ঃ
কবি নজরুল তাঁর লেখার অনেক জায়গায় যেখানে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রশংসা করেছেন সেখানে নবীজী (দ.) এর গুণগাণ গেয়েছেন। যেমনিকরে কুরআন মাজীদের অসংখ্য আয়াতের মাঝে আমরা এটা লক্ষ্য করি যে, আল্লাহর নামের সাথে তাঁর প্রিয় হাবিব নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র নাম উল্লেখ আছে। কুরআনের ভাষায়-
১.    “হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহর অনুসরণ কর ও (তাঁর) রাসূলের অনুসরণ কর এবং তোমাদের মধ্যে যারা নেতৃত্ব দিবেন।
২.    “(হে রাসূল) আপনি বলুন যে, তোমরা যদি আল্লাহর ভালবাসা পেতে চাও তাহলে আমার আনুগত্য কর, এতে আল্লাহ তোমাদেরকে ভালবাসবেন”
কবি এই সমস্ত আয়াতের অনুকুলে কাব্যিক আকারে তাঁর ভাব প্রকাশ করেন।
১.    “খোদারে আমরা করি গো সেজদা, রুসূলে করি সালাম,
ওরাঁ ঊর্ধ্বের, পবিত্র হয়ে নিই তাঁহাদের নাম, 
২.    আল্লাহ রসূল বোল্ রে মন আল্লাহ রসূল বোল।
দিনে দিনে দিন গেল তোর দুনিয়াদারি ভোল॥
রোজ কেয়ামতের নিয়ামত এই আল্লাহ-রসূল বাণী
তোর দিল দরিয়ায় আল্লাহ-রসূল জপের লহর তোল ॥ 
৩.    মোহাম্মদ মোস্তফা নামের (ও ভাই) গুণের রশি ধরি
খোদার রাহে সপে দেওয়া ডুববে না মোর তরী ॥
আল্লাকে যে পাইতে চায় হজরতকে ভালবেসে
আরশ কুরসি লওহ কালাম, না চাহিতেই পেয়েছে সে।
রসূল নামের রশি ধ’রে যেতে হবে খোদার ঘরে, 
৪.    বক্ষে আমার কা’বার ছবি চক্ষে মোহাম্মদ রসুল। 
নবী (দ.) এর প্রতি কবির আকুতি ঃ
কবি তার কবিতায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে কখনো তার নয়ন-মণি, কখনো গলার মালা, আবার কখনো চোখের অশ্রুর সাথে তুলনা করে কবি মনের আকুল কাকুতি-মিনতি প্রকাশ করেছেন। কবি মনে করেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ই তার সবকিছু। এমনকি কবি মানবজাতির বহুল আকাক্সিক্ষত বেহেশতের আশাও ছেড়ে দিয়েছেন যদি পান সেই মহান প্রেমাস্পদ নবী (দ.)কে। যেমন কবির ভাষায়-
মোহাম্মদ মোর নয়ন-মণি মোহাম্মদ নাম জপমালা।
মোহাম্মদ নাম শিরে ধরি, মোহাম্মদ নাম গলায় পরি,
মোহাম্মদ মোর অশ্রু-চোখের ব্যথার সাথি শান্তি শোকের,
চাইনে বেহেশত্ যদি ও নাম জপ্তে সদা পাই নিরালা॥
একত্মবাদের দিশারী ঃ
কবি তাঁর জীবনে একত্মবাদের দিশারী হিসেবেও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে একমাত্র কান্ডারী বলে স্বীকার করেছেন। আমরা তাঁর কবিতায় ও গানে এই বিষয়টির স্পষ্ট উল্লেখ দেখতে পায়। যেমন- “তৌহিদেরি মুর্শিদ আমার মোহাম্মদের নাম।”  কবি পরম সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমত ও দয়া প্রাপ্তির মাধ্যমও মনে করেছেন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে। কবি বলেন- “খোদার রহম চাহ যদি নবীজীরে ধর।” 
পথ-প্রদর্শক কান্ডারী ঃ
কবি মনে করেন মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছাড়া অন্য কেউ বেহেশতের সঠিক পথ দেখাতে পারবে না। একমাত্র সহজ-সরল ও সত্যের পথ মানবজাতিকে দেখানোর জন্যই যেন তিনি পরম সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে এ ধরাধামে আগমন করেছেন। তিনি বলেন- “ইয়া মোহাম্মদ, বেহেশত হতে খোদায় পাওয়ার পথ দেখাও।”   পৃথিবীতে মহান আল্লাহর ঘর বলতে মক্কা নগরীর পবিত্র কাবা শরীফকে বুঝানো হয়ে থাকে। আর হজ্জ ও হজ্জের মৌসুম ছাড়া বছরের অন্যান্য সময়েও সমগ্র পৃথিবী থেকে দলে দলে মুসলমানরা এই ঘর তাওয়াফসহ পবিত্র জায়গাটি কেন্দ্র করে পূণ্য হাসিলের নিমিত্তে ছুটে আসে। জীবনের একটি পরম আকাক্সক্ষা থাকে কাবার পথে যাওয়ার। কবির মনেও ছিল এইরকম এক সুপ্ত বাসনা। আর তিনি প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছেই প্রকাশ করলেন তাঁর এই গহীন ইচ্ছা। তিনি বলেন-“ইয়া রাসুলুল্লাহ! মোরে রাহ্ দেখাও সেই কাবার।” 
শ্রেষ্ঠ নবীর জয়গান ঃ
কবি সমগ্র সৃষ্টিজগতে প্রিয়তম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সবার উপরে স্থান দিয়েছেন। তিনি মনে করেন তাঁর মতো বিশ্বে দ্বিতীয় মর্যাদাবান ব্যাক্তিত্বের অধিকারী আর কেউ নেই। তিনি বলেন আকাশে সবগুলি তারার মাঝে সূর্য যেমন, সমস্ত নবীর মাঝে আমার নবী তেমন। কবির কাব্যিক ভাষায়-
১.    “নবীর মাঝে রবির সম আমার মোহাম্মদ রসুল,
খোদার হাবিব দীনের নকিব বিশ্বে নাই যার সমতুল।”
২.    “বাদশারও বাদশাহ্ নবীদের রাজা তিনি।”

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন